দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা ও হিন্দুত্ব

কানহাইয়ার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সরকারবিরোধী মিছিল
কানহাইয়ার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সরকারবিরোধী মিছিল

কানহাইয়া কুমারের নাম আমি আগে শুনিনি। আমার মতো অনেকেই শোনেননি। ছোটখাটো চেহারার এই ছাত্রটি, যাঁর
বাড়ি বিহারে, যিনি কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী এবং দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) এক ছাত্রনেতা, একটি ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন এবং রাতারাতি গোটা দেশে পরিচিতি পেয়ে গেলেন। তাঁর গ্রেপ্তারি নিয়ে সারা দেশ তোলপাড় হলো। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা ঠোকা হয়েছে। কানহাইয়া কুমার এখন এতই পরিচিত যে ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন তাঁর ঠিকুজি-কোষ্ঠী পর্যন্ত গড়গড় করে আউড়ে দেবেন। দেশের একশ্রেণির মানুষের চোখে এখন তিনি হিরো, কারও কাছে ভিলেন। কানহাইয়া এখন এ দেশের বিতর্কের এক কেন্দ্রবিন্দু।
যে ঘটনায় কানহাইয়া বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত হলেন, এ দেশে তেমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। কাশ্মীরের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে পরিচিত মকবুল বাটের ফাঁসি হয়েছিল দিল্লির তিহার জেলে। মকবুল ছিলেন এক ঝলমলে চরিত্র। কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি মদদে গড়ে তুলেছিলেন ছোট এক বিপ্লবী সংগঠন। ধরাও পড়েছিলেন একাধিকবার। বিপ্লবের জন্য টাকা সংগ্রহে ব্যাংক লুট করতে গিয়ে তাঁর ঠাঁই হয় দিল্লির তিহার জেলে। তাঁর মুক্তির জন্য সঙ্গীরা যুক্তরাজ্যে ভারতের সহকারী হাইকমিশনার রবীন্দ্র মাহত্রেকে অপহরণ করেন। কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে তাঁকে মেরেও ফেলেন। লেস্টারশায়ারের এক খামারে মাহত্রের গুলিবিদ্ধ শরীর পাওয়া যায়। ক্ষিপ্ত ইন্দিরা গান্ধী মকবুলের ফাঁসি কার্যকর করতে বলেন। ১৯৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ফাঁসির পর তিহার জেলেই দাফন করা হয় মকবুলকে।
কাশ্মীরে জঙ্গিয়ানা মাথাচাড়া দেওয়ার সময় থেকে প্রতিবছরই মকবুল বাটের মৃত্যুদিন ঘটা করে পালিত হতো। উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ডাকে হরতাল পালিত হতো, মিছিল বের হতো, গরম-গরম বক্তব্য দিতেন জঙ্গি নেতারা, পুলিশের
সঙ্গে সংঘর্ষও বাধত। কাশ্মীরের গণ্ডি পেরিয়ে সেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেশের অন্যত্রও দেখা যেত। দিল্লিতেও অনুষ্ঠিত হয়েছে অনেক আলোচনা সভা। বক্তারা যে যাঁর মতো ক্ষোভ প্রকাশ করে চলে যেতেন। ইদানীং কাশ্মীরি জঙ্গিদের কাছে মকবুল বাট আর তেমন আলোচিত নন। সেই জায়গায় উচ্চারিত হচ্ছে আফজল গুরু নামটি।
তিহার জেলে ফাঁসি হয় আফজল গুরুরও। মকবুল বাটের ঠিক পাশেই কবর দেওয়া হয় সংসদ হানায় এই অভিযুক্তকে। সেটা ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে আফজল গুরুর ফাঁসির দিনটি কাশ্মীরের অনেকেই তাঁদের বিশ্বাসে, তাঁদের মতো করে উদ্যাপন করে আসছেন। মকবুলের মতো আফজল গুরুর বিচার নিয়েও কোনো কোনো মহলে প্রশ্ন আছে। কয়েক বছর ধরে সেই সব প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে উঠেছে। বিতর্কও হয়েছে। জেএনইউয়ে যেদিন গোলমাল বাধে, সেদিন গুরুকে নিয়ে তৈরি একটা তথ্যচিত্র ওখানে দেখানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। প্রধানত কাশ্মীরি যুবকেরাই ছিলেন আয়োজক, যাঁরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠকেরাও হাজির ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। বাম, অতি বাম—সবাই।
অভিযোগ ওঠে, সেখানে ভারতবিরোধী স্লোগান হয়েছে, স্লোগান হয়েছে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষেও। পরে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকারের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে এসব অভিযোগের পক্ষে যেসব ভিডিও প্রচার করা হয়েছে, তাতে বাড়তি শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মানে ভিডিওতে কারসাজি করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বিজেপির ছাত্রসংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) এই স্লোগানবাজি ও দেশবিরোধিতার বিরুদ্ধে রে রে করে নেমে পড়ে। গ্রেপ্তার হন কানহাইয়া। পরে আরও কেউ কেউ। প্রচারটা এমন হয়ে যায়, যেন কানহাইয়াদের চেয়ে মারাত্মক শত্রু আর নেই। কেউ একজন তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেন। বিজেপি-সমর্থক আইনজীবীদের কেউ কেউ পুলিশের সামনেই আদালত চত্বরে কানহাইকে উত্তম-মধ্যম দিলেন। ভারতে থাকবে, ভারতের খাবে, ভারতের পরবে অথচ ভারতেরই বরবাদি চাইবে? দিকে দিকে উঠে গেল মার ব্যাটাকে, ধর ব্যাটাকে রব। সেই রব আছড়ে পড়ল ভারতের সংসদেও।
জেএনইউর ঘটনার কদিন আগেই ঘটে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা। তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী দরিদ্র দলিত ছাত্রটি বর্ণহিন্দুদের অবিচারে ব্যথিত হয়ে চিরদিনের মতো চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাজ ও রাজনীতিকে উথাল–পাতাল করে দেন। একদিকে রোহিত, অন্যদিকে কানহাইয়াকে কেন্দ্র করে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে কোণঠাসা করতে সব ধরনের দল ও মতের রাজনীতিকেরা হাত মিলিয়ে ফেলেন। রাহুল গান্ধী চলে যান জেএনইউ। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির পাশে বসে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধতার ইঙ্গিত দিয়ে আসেন। লোকসভা ও রাজ্যসভা তোলপাড় হতে থাকে। বহুত্ববাদী ভারতে মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে শুরু হয় চুলচেরা বিতর্ক। দেশ, সমাজ ও রাজনীতি এক লহমায় ভাগ হয়ে যায় দুই শিবিরে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) ও তার আদর্শপুষ্ট রাজনীতি এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আশির দশকের শেষে অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি আন্দোলন সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের উত্থান ঘটালেও বিভিন্ন কারণে হিন্দুত্ববাদী শক্তি সেভাবে ছড়ি ঘোরাতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিত্ব নতুনভাবে সেই সুযোগ এনে দিলেও হিন্দুত্বের জোয়ারে দেশ প্লাবিত হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, মোদি-শাসনের দ্বিতীয় বছরে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জৌলুশ কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে জেএনইউ-বিতর্ক তাদের কাছে এনে দেয় এক মহাসুযোগ। দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহের সংজ্ঞা তারা তাদের মতো করে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় উঠে-পড়ে লাগে এবং প্রতিষ্ঠান দখলের প্রচেষ্টায় দেশপ্রেমকে করে তোলে অন্যতম হাতিয়ার।
ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় না থাকা এবং আদর্শগত অনমনীয়তা এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরই পিছিয়ে রেখেছে। পক্ষান্তরে নেহরুর সমাজতন্ত্র, ইন্দিরা গান্ধীর বামঘেঁষা রাজনীতি প্রশ্রয় দিয়েছে বামপন্থী ভাবধারাকে। জেএনইউয়ে শুধু ছাত্রই নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে বাম ভাবধারার প্রাধান্য। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি তো বটেই, কংগ্রেসও এখানে কখনো তেমন একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি। অটল বিহারি বাজপেয়ির শাসন নিরঙ্কুশ ছিল না বলে প্রতিষ্ঠান দখলে বিজেপিও সেভাবে ঝাঁপাতে পারেনি। এবার আরএসএস শুরু থেকেই সক্রিয়। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে এলেবেলে এক অভিনেতাকে তারা দায়িত্ব দিয়েছে বিতর্কের তোয়াক্কা না করে। কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ডে বসিয়েছে নিজেদের আদর্শের মানুষকে। আইআইটি, হিস্ট্রি কংগ্রেস, সায়েন্স কংগ্রেস, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের লোক বসিয়ে তারা প্রতিষ্ঠান দখলে সচেষ্ট। এ জন্য সামান্যতম সমালোচনাও তারা রেয়াত করতে রাজি নয়। ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ থেকে আমির খানের বাদ পড়া বোঝায়, আদর্শ ও তার বাহকেরাই প্রথম ও শেষ কথা।
আরএসএসের ব্যাখ্যায় হিন্দুত্বই ভারতীয়ত্ব। ‘ধর্ম রক্ষার’ সেই লড়াইয়ে এত দিন তারা মন্দিরের আন্দোলন করেছে,
গো-মাতার পূজা করেছে, ধর্মান্তরে উৎসাহ দিয়েছে, হিন্দু নারী রক্ষায় লাভ জিহাদের জিগির তুলেছে। পূর্ণ ক্ষমতা লাভের পর এখন তারা রাজ্যে রাজ্যে গো-মাংস নিষিদ্ধ করছে, প্রচার চালাচ্ছে নিরামিষ খাওয়ার। এ জন্য দেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি (মাংস রপ্তানিতে ভারত দ্বিতীয়) ও বেকারত্ব বৃদ্ধির কথা ভাবার ফুরসতও তাদের নেই। রাজ্যে রাজ্যে স্কুল সিলেবাস তারা বদলাচ্ছে নিজেদের বিচার অনুযায়ী। হিন্দুত্ব তথা ভারতীয়ত্বের বিকাশে এই প্রথম তারা যোগ করল দেশপ্রেমকে, নব কলেবরে। দেশপ্রেমের স্থান নিল উগ্র দেশপ্রেম। কানহাইয়ারা যার বলি।
ভারতের রাজনীতিতে বেশ কিছু হেঁয়ালির উত্তর পাওয়া যায় না। উগ্র দেশপ্রেম নবতম হেঁয়ালি। বরাবরই দেখেছি মহারাষ্ট্রের শিবসেনা ও কট্টর বিজেপি নেতাদের নানাভাবে পাকিস্তানি সংস্রব পরিহার করে চলতে। জেএনইউ বিতর্ক সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাল।
হিমাচল প্রদেশের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিং পাঠানকোট-কাণ্ডের দোহাই দিয়ে ধর্মশালার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আপত্তি জানালেন। কী আশ্চর্য, প্রতিবাদী হলেন বিজেপির তরুণ সাংসদ, ক্রিকেট-কর্তা অনুরাগ ঠাকুর! আরও আশ্চর্য, রাহুল গান্ধীদের মুখে কুলুপ, যাঁরা এই সেদিনও পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালানোর পক্ষে সরকারকে চাপ দিয়ে এসেছেন! আলোচনার দরজা বন্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছেন!
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বহু প্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ পেরোতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য বিস্তারে এখন উগ্র দেশপ্রেম তাঁদের নবতম হাতিয়ার।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।