'চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব'

‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডেপুটি-মুন্সেফের চেয়ে বড়ো, তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে, এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের
চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, এই কথাটা আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে। এইটে বুঝিতে না পারার মূঢ়তাই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো মূঢ়তা। আমাদের সমাজে এ কথা আমাদিগকে বোঝায় না, আমাদের ইস্কুলেও এ শিক্ষা নাই।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘আমি যখন চাকরি করতাম, তখন একবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বেশ খাতিরই করেছিলেন। এরপর আমি নিজে একটা সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান শুরু করি। এখন সেখানে ১৪ জন প্রোগ্রামার ও কর্মী রয়েছে। তারা সবাই ব্যাংকঋণের উপযুক্ত। কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠানটি এখনো ব্যাংকঋণের জন্য উপযুক্ত হয়নি। কারণ, আমাদের স্থাবর “জামানত” নেই।’ অভিজ্ঞতার গল্প করছিলেন মুক্ত সফটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী তামিম শাহরিয়ার। তামিম অভিজ্ঞতার গল্প বলছিলেন তাঁর মতো আরও কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তার জন্য আয়োজিত উদ্যোক্তা বুট ক্যাম্পে। সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের উদ্যোগে সম্প্রতি নবীন উদ্যোক্তাদের একটি বুট ক্যাম্প হয়েছে ঢাকায়। সেখানে ২৬ জন নবীন ও হতে চাওয়া উদ্যোক্তা জড়ো হয়েছিল নিজেদের দক্ষতা, জ্ঞান এবং নেটওয়ার্কিংকে সমৃদ্ধ ও ঝালাই করতে। তাদের কেউ কেউ পণ্যের গায়ে প্রিয়জনের ছবি ছাপিয়ে দেয়, কেউ ‘সুখ’-এর বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে ভাবে, আর কেউবা ভাবে, কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং থেকে উদ্যোক্তা হবে। একই দিন সকালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম আলো জবসের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের চাকরিপ্রাপ্তির সমস্যা নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক হয়েছে। সেখানে উপস্থিত দেশীয় করপোরেটগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত মধ্য লেভেলের ব্যবস্থাপক পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে ব্যবস্থাপকেরা আসতে শুরু করেছেন!
আমাদের দেশে এখন প্রতিবছর প্রায় ২১ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মবাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে প্রায় সাত লাখই বিদেশে পাড়ি জমায়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়েক লাখের কর্মসংস্থান হয়। কোনো রকম প্রণোদনা ছাড়াই আমাদের গ্রামীণ হাটবাজারগুলো প্রতিবছর গড়ে তিনজনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। তার পরও প্রায় ১০ লাখের কোনো গতি হয় না। তাদের অনেকেই ‘একটি চাকরি’র জন্য জীবনপণ করে লড়তে থাকে। সরকারি চাকরির সোনার হরিণ ধরার জন্য সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষায় মাত্র দুই হাজার পদের বিপরীতে দুই লাখ ২১ হাজার প্রার্থী আবেদন করেছে। এর মধ্যে অনেকেই কয়েকবার করে এই বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চলেছে। আর আমরা যতভাবেই হিসাব করি না কেন, প্রায় সোয়া দুই লাখ চাকরিপ্রত্যাশীর মধ্যে দুই লাখ ১৯ হাজারেরই চাকরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা ব্যাপারটাকে দেখতাম, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও এই সমস্যার সমাধান করা যেত। সেটি হলো আমাদের তরুণ প্রজন্মকে চাকরির পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানে আগ্রহী করে তোলা। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সমাজকে উদ্যোক্তাবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা। গ্রামের কোনো এক তরুণ মাত্র ৫০ হাজার টাকার অভাবে নিজের পুকুরটিকে একটি লাভজনক খামারে পরিণত করতে পারে না। কিন্তু সেই তরুণ যখন মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের চাকরি করার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে, তখন অবলীলায় তিন লাখ টাকাও জোগাড় হয়ে যায়! প্রতিবছর কর্মপ্রত্যাশীদের মাত্র ১০ শতাংশকেই যদি আমরা আত্মকর্মসংস্থানে আগ্রহী করে তুলতে পারতাম, তাহলে আমাদের অনেক সমস্যারই সমাধান করে ফেলতে পারতাম।
আশার কথা হলো, আমাদের তরুণদের অনেকেই এখন নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি-ব্রিটিশ তরুণ উদ্যোক্তা সাবিরুল ইসলামের বাংলাদেশ সফরের সময় আমরা এর কিছুটা নমুনা দেখেছি। না, কোনো কনসার্ট বা জাদু বা অভিনয়শিল্পীদের সমাগম নয়, একজন সফল উদ্যোক্তার গল্প শোনার জন্য দেশের বিভিন্ন শহরে তরুণেরা দল বেঁধে হাজির হয়েছে। এই তরুণদের কেউ কেউ এরই মধ্যে পথে নেমে পড়েছে। তাদের রয়েছে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা। আবার অনেকেই বেছে নিয়েছে স্বতন্ত্র উদ্যোক্তা হওয়ার পথ। দেশের একটি স্বনামখ্যাত পারিবারিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান গত ৫০ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, ইন্টারনেটকে নির্ভর করে এখন দেশের প্রায় ৩০ হাজার তরুণ-তরুণী নিজেদের ‘ভার্চুয়াল’ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। এই তরুণেরা এখন প্রতিদিনই প্রায় এক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আনছে দেশে। তাদের এক-দশমাংশকে যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা, যেমন কিছু উদ্যোগ-সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ, ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের দক্ষতার বিকাশ এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য কিছু আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেত, তাহলে তারাই বছরে নতুন তিন লাখ কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করতে পারত! আর এসব ছোট প্রতিষ্ঠান আমাদের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তার জোগানদার হয়ে উঠত। গোলটেবিল বৈঠকে জেনেছি, ১০ বছর পর আমাদের প্রতিবছর প্রায় এক লাখ উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপক প্রয়োজন হবে। সেই লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশই পূরণ হবে না, যদি আমাদের জোগানের সংখ্যা না বাড়ে!
কাজেই আমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে নতুন আর হবু উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্মকর্মসংস্থানের মূল বিষয়গুলো শিক্ষাক্রমের আওতায় আনতে হবে। ক্যারিয়ার ক্লাবের পাশাপাশি এন্ট্রাপ্রেনিউর ক্লাব বানাতে হবে। শিক্ষার্থীরা জীবনবৃত্তান্ত লেখা যেমন শিখবে, তেমনি ঋণের প্রস্তাব আর উদ্যোগের পরিকল্পনাও করতে শিখবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু কিছু ব্যবসা উদ্যোগ-সম্পর্কিত প্রতিযোগিতা ইদানীং শুরু হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া উদ্যোগগুলো যাতে শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নিতে
পারে, তার জন্য চেষ্টা চালাতে উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেশে যেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আর এনজেল ইনভেস্টরদের উদ্যোগগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি ভিত্তি পায়, সে জন্য আরও তৎপর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। কয়েকটি ছোট নীতিমালা হলেই প্রবাসীরা তরুণদের উদ্যোগে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাত্র ১০ শতাংশকে যদি জমির দাম বাড়ানো থেকে বিনিয়োগে রূপান্তর করা যায়, তাহলেই বছরে নতুন দেড় লাখ উদ্যোক্তার সংস্থান হয়ে যেতে পারে।
প্রতিবছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্ব উদ্যোক্তা সপ্তাহ হিসেবে পালিত হয়। এ বছর এটি আমাদের দেশেও নানাভাবে পালিত হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আয়োজিত হয়েছে শুরুতে উল্লেখ করা ‘উদ্যোক্তা বুট ক্যাম্প’। হচ্ছে আরও নানা আয়োজন।
কেবল সাহস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে অনেক তরুণ-তরুণীই এখন পথ না হারানোর পথে নেমে পড়েছে। তাদের জীবনের মূল মন্ত্র হয়ে উঠছে, তারা ‘চাকরি খুঁজবে না, চাকরি দেবে’।
পরিবার, ব্যাংক, স্থানীয় করপোরেট, সরকার আর সমাজ—সবাই মিলে আমরা যেন তাদের ভরসা হতে পারি।
মুনির হাসান: সমন্বয়কারী, যুব কর্মসূচি, প্রথম আলো ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।