ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ

>

মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপে বসেছিলেন মঈদুল হাসান। উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল থেকে সে স্মৃতির অংশবিশেষ। সময় ৩০ মে থেকে জুন, ১৯৭১

১৯৭১: ভারতীয় সেনাদল পরিদর্শন করছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
১৯৭১: ভারতীয় সেনাদল পরিদর্শন করছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী


[অধ্যাপক] ড্যানিয়েল থর্নার আমাকে বলেন, [ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব] পি এন হাকসার পরদিন বেলা ১১টায় আমাদের ‘কফি খেতে ডেকেছেন’। আমি ধরে নিই, প্রকৃত আলোচনার সময় ততটা লম্বা না-ও হতে পারে। কাজেই আগের কয়েকটা দিন যেসব তথ্য ও সমীক্ষা সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় রেখে তাজউদ্দীন যে কিছু জানতে চেয়েছিলেন, তার উপস্থাপন ফলপ্রসূ করার জন্য আমি গুছিয়ে নোট করে নিই।
পুরোনো বন্ধু ড্যানিয়েলকে পেয়ে পি এন হাকসার অত্যন্ত আনন্দিত হন, আমার প্রতি সমাদরেও কোনো ঘাটতি রাখেন না। দিনটি ছিল তাঁর সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাঁর পত্নী, দুই কিশোরী কন্যা আর ড্যানিয়েলের উপস্থিতিতে প্রথমেই পারিবারিক প্রসঙ্গ এসে পড়ে। একটু পর হাকসার অক্লেশে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ হাজির করলে আমার পক্ষে কথা বলার সুযোগ আসে। আমি আমার কথা শুরু করি এপ্রিলে ঢাকার পরিস্থিতি থেকে শুরু করে কলকাতায় দুই সপ্তাহের অভিজ্ঞতা এবং অবশেষে দিল্লি আসার পর এই এক সপ্তাহে ঘটা নিজের উপলব্ধির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে। আমি বলি, এই যাত্রার সময়জুড়ে কীভাবে স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের পরিপ্রেক্ষিত বোধ বিবর্তিত হতে থাকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আমার ধারণাও কীভাবে বদলাতে থেকেছে। কোনো প্রশ্ন না করেই হাকসার আমার কথা শুনে গেলেন। তবে তাঁর অভিব্যক্তিতে আমি যেন আগ্রহের একটি আভাস দেখতে পাই। ফলে তাঁর কাছে আমি আমার ভাবনার সব কিছু একসঙ্গে এভাবে ব্যক্ত করে ফেলি:
সামনে এগোনোর কোনো পথই বর্তমানে পরিষ্কার নয়। শরণার্থীর বিরামহীন প্রবাহ ভারত সরকারের জন্য এক অদৃষ্টপূর্ব রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের সাহায্য নিয়ে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও লড়াই করে বাংলাদেশ মুক্তিলাভের কোনো বিশাল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। বরং এর ফলে পাকিস্তানি পাল্টা আঘাত আরও তীব্র হতে পারে, শরণার্থীর স্রোতও আরও বেড়ে যেতে পারে। যারাই চেষ্টা করুক না কেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সমাধানে’ পৌঁছানোর জন্য সেগুলোও কোনো কাজে আসবে না। শরণার্থীরা যেমন পাকিস্তানি সৈন্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আস্থা পাবে না, তেমনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও তাদের নিজেদের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় সৈন্য প্রত্যাহার করতে সম্মত হবে না। শরণার্থীরা ফিরে যেতে রাজি হবে কেবল মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশেই। আর বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে এক সুপরিকল্পিত রণকৌশল অনুযায়ী বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যুদ্ধে সশস্ত্র তত্পরতা নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু চীনের যোগসাজশে আগাম যুদ্ধ শুরু করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে চীন কৌশলী আক্রমণও চালাতে পারে। পাকিস্তানকে নিবৃত্ত করার জন্য দরকার চীনকে থামিয়ে রাখা। এর কার্যকর পন্থা একমাত্র আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের। কেননা চীনের বিরোধপূর্ণ সীমান্তে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা দরকার। এ জন্য যদি সহায়ক হয়, তবে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী দুই দল কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করে একটি আদর্শগত কাঠামো দাঁড় করানো যেতে পারে। এ ধরনের ঐক্য দেশের অভ্যন্তরে যে রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলবে, তা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সহায়ক হবে। এরপর বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কবে চূড়ান্ত সামরিক পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্থির করতে হবে ভারতকেই।
এ ছিল এক জটিল ও ক্লান্তিকর উপস্থাপনা। কিছু কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ সময়ও লেগে যায়। কিন্তু পি এন হাকসার মনোযোগের সঙ্গে আগাগোড়া আমার কথা শুনে যান। তারপর উঠে গিয়ে কাউকে ফোন করে বলেন, ‘প্রফেসর সাহেব, আপনার হাতে যদি সময় থাকে, আমাদের এখানে চলে আসুন না। দুপুরে যা-ই আছে, একসঙ্গে খাওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকে আসা একজন এখানে আছেন।’ কিছু সময় পরই আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা পি এন ধর। তবে তিনি এসে পৌঁছার আগেই পি এন হাকসার আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। প্রথমেই তিনি জানতে চান, আওয়ামী লীগ কি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য গড়তে রাজি হবে? আমি বলি, আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐক্য গঠনের বিরোধী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রায় সব আসনে জয়ী হওয়ার পর তাদের এ অবস্থান সংগত কারণেই আরও দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। তাই তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন ঘটছে। বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটা অংশের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সব দলের সঙ্গে ন্যূনতম কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্য গড়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। গেরিলা তত্পরতায় সহায়তা জোগাতে দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তোলা প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিই এই নতুন চিন্তাভাবনার ভিত্তি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে আওয়ামী লীগের অনেকেই মনে করেন।
পি এন হাকসার জানতে চান, আওয়ামী লীগের সেই অংশটির নেতা কে। আমি তাজউদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখ করি। তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলি, ‘কিছুক্ষণ আগে আমি আপনাকে যেসব কথা বলেছি, সেসব নিয়ে তাজউদ্দীনের সঙ্গে আগেই আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এটা তাঁরই পরামর্শ যে মুক্তিসংগ্রামের এই বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা আপনার গোচরে আনা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে আপনার সঙ্গে তিনিই বৈঠকের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাঝখানে ড্যানিয়েলের প্রবল উত্সাহে সে পরিকল্পনা খানিকটা পাল্টে যায়। প্রথমে ভাবনাগুলো তার নিজস্ব যুক্তিতে হাজির করার এবং পরে এসব ভাবনার পেছনের মানুষগুলোকে উপস্থাপন করার জন্য আমার বরং সুবিধাই হয়েছে।’ হাকসারের পণ্ডিতবন্ধু ড্যানিয়েল থর্নার আমাদের পাশে বসে নিঃশব্দে সব কথা শুনছিলেন। এ পর্যায়ে তিনি আর আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি। ফিরে আসার আগে হাকসার আমাকে বলেন, আমি যদি আমার কলকাতায় ফেরা এক দিন পিছিয়ে দিয়ে মঙ্গলবার সাউথ ব্লকের দপ্তরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তাহলে ভালো হয়।
১ জুন মঙ্গলবার আমি দিল্লির সাউথ ব্লকে পি এন হাকসারের সঙ্গে আবার মিলিত হই। তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং ঘনিষ্ঠজনের মতো সহজভাবে কথাবার্তা বলেন। তাঁর কথাবার্তার ধরন থেকেই আমার মনে হয়, আগের দিন আমি তাঁকে যেসব কথা জানিয়েছি, তিনি এর মধ্যেই সেগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করে দেখেছেন। এ বৈঠকে তিনি বাংলাদেশে একটি বহুদলীয় মোর্চা গঠনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মোর্চা গঠনের জন্য প্রাথমিক করণীয় কী হবে, সে বিষয়ে আমার ধারণা জানতে চান। অবশেষে বলেন, এ বিষয়ে কী অগ্রগতি ঘটে, তা জানার জন্য সাগ্রহে তিনি অপেক্ষা করবেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো একজনের উচিত হবে দিল্লির সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত বা সেই দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা এবং নিয়মিত মতবিনিময়ের লক্ষ্যে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। নিরাপত্তা বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারত কোনো সমঝোতা বা সহযোগিতা চুক্তি করবে কি না, সে সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। অন্যদিকে বৃহত্তর যুদ্ধ বাধিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করতে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্ভাব্য যোগসাজশ নিয়ে আমাদের ধারণা সম্পর্কেও তিনি কিছু বললেন না। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাবে তাঁর আগ্রহ এবং দিল্লির সোভিয়েত দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পরামর্শ শুনে আমার মনে হয়, আমাদের পলিসি প্রস্তাব ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের কাছে বিবেচনার যোগ্য বলে মনে হয়েছে।
কলকাতায় ফিরে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশ পলিসি নিয়ে দিল্লির সরকারি মহলের নানা বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অবহিত করি। পি এন হাকসারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নিরাপত্তার প্রশ্নে একটা সাধারণ সমঝোতায় পৌঁছা গেছে, সে কথাও তাঁকে জানাই। তাজউদ্দীন বলেন, জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের কাজ তিনি শিগগিরই শুরু করতে পারবেন।