রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলন-বৃত্তান্ত ২

বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে সমবেত নেতা–কর্মীরা
বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে সমবেত নেতা–কর্মীরা

রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং জাতীয় নেতাদের অভিভাষণ যাঁরা রচনা করেন, সেই স্ক্রিপ্ট রাইটারদের প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে যেমন নেতার নির্দেশ নিতে হয়, তেমনি তাঁদের নিজেদের হোমওয়ার্ক করতে হয়। শুধু হোমওয়ার্কও নয়, আউটডোর ওয়ার্কও করতে হয়। আউটডোর ওয়ার্ক হলো সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। একজন মানুষ কোনো ব্যাপারে যতই ভালো বুঝুন না কেন, অন্য একজন যে তাঁর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি বুঝবেন না—তা মনে করা নির্বুদ্ধিতা। কোনো জাতীয় ইস্যুতে যখন কোনো নেতা বক্তব্য দেন, তাঁকে খুব ভেবেচিন্তে তা করতে হয়। কারণ, তাঁর ওই বক্তব্য কত ভাগ মানুষের মনে কী রকম সমর্থনসূচক প্রতিক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা আগেভাগে অনুমান করা ভালো।
এই কথাগুলো বলছি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার অভিভাষণ প্রসঙ্গে। তাঁর ওই অভিভাষণটি টেলিভিশনে আংশিক শুনেই আমার মনে হয়েছে তিনি তাঁর দলের প্রতিনিধি সম্মেলনে নয়, ভাষণ দিচ্ছেন একটি কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে। একটি সাংবিধানিক সংস্কার সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচনা হতে পারে, সেগুলোই তিনি তাঁর দলের জাতীয় সম্মেলনে পাঠ করলেন।
এই মুহূর্তে তাঁর দলের করণীয় কী, এই মুহূর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কী রকম ভূমিকা রাখতে হবে, সে বিষয়ের চেয়ে সাংবিধানিক সংস্কারের মতো বিরাট ও কঠিন ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। ওগুলো বাস্তবায়ন যে চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, তা দুই–আড়াইবার প্রধানমন্ত্রিত্ব করার পর তাঁরই ভালো জানার কথা। আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের ওসব সম্পর্কে ধারণা সামান্যই। প্রশ্ন জাগে, আগামীকাল সকালেই যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে বেগম জিয়াকে বলেন, আমার আর ভালো লাগছে না, আপনার হাতে আমি ক্ষমতা দিয়ে বিশ্রামে গেলাম। তিনি কি তাঁর সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবেন? তাঁর দলের কি সেই প্রস্তুতি ও দক্ষতা আছে?
বাংলাদেশের মানুষ এখন একটা ভিশন (ভীষণও বটে) অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ভিশনেই মানুষের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি; তার মধ্যে যোগ হলো বিএনপির ভিশন। এত রকমের ভিশনে বাংলাদেশের মানুষের যে ভীষণ রকমের নাভিশ্বাস উঠবে তাতে সন্দেহ করবে খুব কম আশাবাদীই। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের মৌলভি বাবুনগরীদের অঘোষিত ভিশন তো আছেই। তবে তাঁরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ১৪ বছর অপেক্ষা করবেন, তা বেকুব ছাড়া কেউ মনে করে না।
বাংলাদেশে অগণিত রাজনৈতিক দল আছে। তার মধ্যে মাত্র দুটি দলের দুজন নেতাই দলের ঐক্যের প্রতীক এবং জাতীয় সংহতিরও প্রতীক। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা এবং বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া। তাঁদের প্রতি, তাঁরা যতই পরস্পরের বিরোধী হোন না কেন, জনগণের আস্থা আছে এবং তাঁদের নিজ নিজ দলের নেতা-কর্মীদেরও রয়েছে পূর্ণ আস্থা। খালেদা জিয়ার ঘোরতর শত্রুকেও স্বীকার করতে হবে, তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা। কিছুকাল ধরে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এবং রাজনৈতিক জীবনে চরম দুঃসময় অতিক্রম করছেন। তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের অকালমৃত্যু তাঁকে চরম আঘাত দিয়েছে। তাঁর অরাজনৈতিক ছেলের জানাজায় যে জনসমাগম হয়েছিল, তা তাঁর প্রতি জনগণের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর প্রতি সমবেদনা জানাতে আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাসভবনে গিয়েছিলেন। বিএনপির দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতারা তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে দেখা করতে না দিয়ে চরম অভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বড় ছেলে সপরিবারে বিদেশে। বিএনপি ভাঙার জন্য হয়েছে নানা রকম বালসুলভ ও হাস্যকর চেষ্টা। কখনো ‘আসল বিএনপি’ নেতাদের মাঠে নামিয়ে মার খাওয়ানো, কখনো ব্যারিস্টারকে দিয়ে ঘন ঘন প্রেস কনফারেন্স করানো এবং বিচিত্র দল ও জোট গঠন এবং ধানের শীষের মতোই গমের শীষ নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ এবং সবশেষে জিয়াউর রহমানের বৃদ্ধ ও অজ্ঞাত–অপরিচিত ভাইকে মাঠে নামানো। নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম তো আছেই। এর মধ্যেই কোনোরকমে একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করা সামান্য কৃতিত্ব নয়। ওই সম্মেলনে বিএনপি যতটা লাভবান হয়েছে, তার চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে সরকার। বাংলাদেশে বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না বলে বহির্বিশ্বে যে দুর্নাম আছে, সেই বদনাম অনেকটা ঘুচেছে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সম্মেলনের পরে।
যাঁর প্রতি জনগণের আস্থা আছে, তাঁকে খুব দায়িত্ব নিয়ে ও সতর্ক হয়ে কথা বলতে হয়। সম্মেলনে খালেদা জিয়ার সমঝোতামূলক
বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। আমরা ধরে নেব তিনি কথার কথা বলেননি। তাঁর ওই সংস্কার প্রস্তাব যদি কোনো সেমিনারে বা গোলটেবিলে কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা নাগরিক সংগঠনের
নেতা বলতেন, আমরা খবরের কাগজে পড়ে তা ভুলে যেতাম। কিন্তু তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি যখন বলেন তখন তা অবহেলা করার বিষয় নয়।
দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদের প্রস্তাব ’৭২ থেকে অনেকবার অনেকেই করেছেন, কিন্তু আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। দুই কক্ষের উপযোগিতা হলো এই যে তাতে নানা জাতি-ধর্ম শ্রেণি-পেশা এবং দেশের বিশিষ্ট ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের বিভক্ত সমাজের যে চরিত্র এবং দলীয়করণের যে চিত্র তাতে দ্বিকক্ষ নয়, পঞ্চ কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বানালেও বিশেষ উপকার হবে না দেশের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় উচ্চকক্ষে কারা কারা সাংসদ হবেন, তাঁদের নাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কেয়ারটেকারের কাছে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতে পারবেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে উচ্চকক্ষের সাংসদ কারা হবেন তা লন্ডনে তারেক রহমানকে টেলিফোন করলে এক্ষুনি জানা সম্ভব। সুতরাং এই প্রস্তাব করার আগে খালেদা জিয়ার ভেবে দেখা উচিত ছিল।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রেফারেনডাম বা ‘গণভোট’ সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তনের যে প্রস্তাব করেছেন, তা অতি ভালো দাবি। যে দেশে গণভোটের ব্যবস্থা নেই, সেটা আবার গণতান্ত্রিক দেশ হয় কী করে? জাতীয় নেতারা স্বৈরাচারী মনোভাব ও স্নায়বিক দুর্বলতাবশত ওই ধারাটি বাতিল করেছেন। ওই ধারাটি অবশ্যই সংবিধানে থাকা উচিত, তবে সে গণভোট যেন সামরিক শাসকদের গণভোটের মতো না হয়, সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ধ্বনিত হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আচরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।’ অতি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। এই কথাটি ’৭২-এর সংবিধান রচনার সময়ই অনেকে তোলেন, কিন্তু তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
বাহাত্তরের সংবিধান লেখা হয়েছিল পাকিস্তানের ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্র এবং ভারতীয় সংবিধানের অনুসরণে। জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য বিচার বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট যতটা ক্ষমতাবান বা সার্বভৌম, বাংলাদেশের সংসদ তা নয়। ব্রিটিশ ব্যবস্থায় যে আইন পার্লামেন্ট পাস করেছে, বিচার বিভাগ তাকে ক্ষমতাবহির্ভূত বলে ঘোষণা করতে পারে না। আমাদের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে করেছে নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রের প্রধান প্রশাসক এবং পার্লামেন্টেরও নেতা। কিন্তু তাঁকে সৃষ্টি করেছে সংসদই। আমাদের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী যেমন পার্লামেন্টের সৃষ্টি, তেমনি তাঁকে পার্লামেন্টকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। এর ব্যাখ্যা হলো এই যে, যদি কোনো প্রধানমন্ত্রী মনে করেন সংসদে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নেই, কিন্তু জনগণ তাঁকে সমর্থন করে, তখন তিনি ৫৭ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন এবং নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা বলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন—এই ভীতি সব সাংসদের মধ্যে কাজ করে। কখনো কোনো কোয়ালিশন সরকারের সংখ্যালঘু দলের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ক্ষমতার জোরে অন্য দলের সদস্যদের প্রভাবিত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন।
আমাদের সংবিধান বলছে, দেশের মালিক জনগণ কিন্তু ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের পরেই তাঁরা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং সেই দলের নেতা—সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী—সব ক্ষমতার অধিকারী হন। অন্য সব সাংসদ শক্তিহীন হয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, নিজ দলের সাংসদেরাও নিবীর্য হয়ে যান। ৫৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর এত ক্ষমতার কারণেই তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মন্ত্রিত্ব রক্ষায় তাঁর কাছে নত হয়ে থাকতে বাধ্য। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সেই ক্ষমতা কমাতে চাইছেন, খুবই ভালো কথা, তবে তিনি কতটা কীভাবে কমাবেন, তা তিনি এবং বিধাতা ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কেউ জানে না।
যাহোক, খালেদা জিয়া সামাজিক সমঝোতার কথা বলেছেন এবং মোবাইল ফোন কোম্পানির মতো ‘থ্রিজি’ বা তিন ‘সু’র কথা বলেছেন, তাঁকে আমরা স্বাগত জানাই। এবং শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন শেষ করায় বিএনপি নেতাদের ধন্যবাদ এবং সরকারকেও ধন্যবাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।