বাংলাদেশ কেন 'গ্রেট গেম'-এর শিকার হবে?

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই

মধ্য এশিয়ার বহু দেশের একটি খেলার নাম ‘বুজকাসি’। খেলাটি হলো মস্তকবিহীন মৃত মেষকে দুই দল ঘোড়সওয়ারের মধ্যে গোলপোস্টে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এটি মুণ্ডবিহীন মেষ নিয়ে টানাটানি। খেলাটি আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ও জাতীয় খেলা। অনেকের মতে, খেলাটি চেঙ্গিস খানের মধ্য এশিয়া অভিযানের পর শুরু হয়েছিল। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, এ খেলার মতো আফগানিস্তানকে নিয়ে বুজকাসির মতো টানাটানি শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যা কার্যত শেষ হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ভূকৌশলের ইতিহাসে এটি ‘গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত।
এই খেলার এক প্রান্তে ছিল পরাশক্তি রাশিয়া, অন্য প্রান্তে ভারতের ব্রিটিশরাজ। উভয়ই আফগানিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব ও প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠে। এ কারণেই সংঘটিত হয় প্রথম আফগান যুদ্ধ এবং ব্রিটিশরাজ দখলে নেয় দেশটি। এ যুদ্ধ প্রাথমিক পর্যায়ে শেষ হয় ১৯১৯ সালে, তৃতীয় আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি রাওয়ালপিন্ডি চুক্তির মাধ্যমে। ব্রিটিশরাজ আফগানিস্তানকে রাশিয়া ও ব্রিটিশ-ভারতের মধ্যে ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে থাকার অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে দেশটির সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়।
এ খেলা আফগানিস্তানে নতুনভাবে শুরু হয় শীতল যুদ্ধের সময়ে, যাতে দুই পরাশক্তি জড়িয়ে পড়ে। আজ আফগানিস্তানে হানাহানি আর বিদেশিদের দখলদারি চলছে। ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার কারজাই সরকার। বর্তমানে ভারত ও চীনের মধ্যে নতুন করে ভূকৌশলগত ‘খেলা’ শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, চীনের পেছনে পাকিস্তান আর ভারতের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বুজকাসি আমাদের দেশের খেলা নয়। কিন্তু বুজকাসির মতো আমরাও পড়েছি দুই শক্তির টানাটানির মাঝে। বিশেষ করে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক ডামাডোলে খেলাটি অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। কোনো রাখঢাক নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, অধুনা বাংলাদেশকে নিয়ে এ অঞ্চলে গ্রেট গেম শুরু হয়েছে। বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারত রয়েছে এই গ্রেট গেমের দুই পাশে। এ ক্ষেত্রে চীন কার পেছনে রয়েছে, তা অনুমানযোগ্য।
মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রকাশ্যে বলেছেন যে তাঁর দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটা ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আপাতদৃষ্টে মতভেদ শেষ হওয়ার কথা বলা হলেও টানাটানি চলছে নেপথ্যে। কিছুদিন আগে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় আমেরিকান নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকায় তিন দিনের সফরে এসে আমাদের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সংকট নিরসনের অছিয়ত করে গেলেন। আর রাজনীতিবিদেরাও খুবই উৎসাহের সঙ্গে তাঁর কথা শুনলেন। তাঁর ডাকে একই ছাদের নিচে জড়ো হলেন, যাদের যুদ্ধাপরাধীর দল বলে অপাঙেক্তয় করা হয়েছে, সেই জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলের নেতারাও। অথচ দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে তীব্র বিরোধ চলছে দুই জোটের মধ্যে। কয়েক মাস আগেও সরকারি দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বললেও এখন আর বলছেন না।
যদিও নিশা বিসওয়াল আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কী আলাপ করেছেন, তা সাধারণ মানুষ জানতে পারবে না। তবে তাঁর ছোট ছোট বক্তব্য ও অভিব্যক্তি ইঙ্গিত দেয় যে সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবে না হলে বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে যেতে পারে। রয়টার্স খবর এজেন্সির এক লেখায় তিনি বলেছেন যে চলমান সংকট রাজনৈতিকভাবে সমাধান না হলে বাংলাদেশের জনগণ দুই প্রধান দলের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে পারে। বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এ উক্তি তাঁর নিজস্ব মতামত হতে পারে না, যেমনটি আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মুখ থেকে হরহামেশাই বের হতে থাকে। নিশা বিসওয়ালের ইঙ্গিত কি তাহলে বাংলা বসন্তের আভাস? সে ধরনের কিছু হলে সত্যিই উদ্বেগজনক। নিশা দেশাই বিসওয়াল একতরফা নির্বাচনের ওপর তাঁর মতামত সরাসরি না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।

দুই.
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই আমরা রাজনীতিকদের অবস্থানের বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করি। ‘সর্বদলীয়’ বা ‘নির্বাচনকালীন’ নামে মন্ত্রিসভায় আটজন মন্ত্রী যুক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে চারজন পূর্ণ এবং একজন প্রতিমন্ত্রী সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির যোগদান নিয়ে এখন নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছে গণমাধ্যমে। এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান এর আগে এত বেশি বিতর্কের মধ্যে পড়েনি, যদিও কখনোই তিনি বিতর্কের বাইরে ছিলেন না। তিনি মহাজোটের শরিক ছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি যে ধরনের বক্তব্য, সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার উদিগরণ করেছেন, তার ঠিক বিপরীত কাজটি করায় হকচকিয়ে গেছেন রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা। বর্তমানে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অথবা বিরোধী দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন—উভয় ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পার্টি, যার অস্তিত্বই সংকটে পড়বে। তবে জোটবিহীন জাতীয় পার্টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। অনেকের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করে এরশাদ বেশ কিছু সুবিধা আদায় করেছেন। অন্তত পাঁচজন মন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টার পদ পেয়েছেন। অপ্রকাশ্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ও রাজনৈতিক মহলে আলোচিত।
এরশাদ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য না দিলেই ভালো করতেন। তথ্যে প্রকাশ যে বিরোধী জোট যদি নির্বাচনে না আসে, তবে জাতীয় পার্টি আলাদা নির্বাচন করবে এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তবে বিরোধী দল নির্বাচনে যোগ দিলে জাতীয় পার্টি আবার মহাজোটে ফিরে যাবে। তেমনটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রেও জাতীয় পার্টি আগের অবস্থায় থাকবে কি না, সন্দেহ। পার্টি-প্রধানের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্টির ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভাঙনের মুখে পড়তে পারে দলটি। ইতিমধ্যে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী জাফর আহমদ এক বিবৃতিতে তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছেন।

তিন.
নিশা বিসওয়ালের বাংলাদেশ সফরের এক দিন পরেই রাজনৈতিক মঞ্চপটে আরেকটি অঙ্ক রচিত হলো। বিরোধীদলীয় নেতা ১৯ জন সদস্যসহ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক হয়। বৈঠকে বিরোধী দল তাদের নির্দলীয় সরকারসহ অন্যান্য দাবিও তুলে ধরে। এর মধ্যে নতুনভাবে সংযোজিত হয় নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন। কারণ, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই বিরোধী দলের, যদিও অতীতে বেশ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীরা। ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবে বিরোধী দলের পক্ষে হলেও, পরে বিএনএফ নামের দলটিকে যেভাবে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন, সেটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করে তারা। লক্ষণীয় যে এই দলটিকে যেভাবে কমিশন নিবন্ধন দিয়েছে, তাতে সন্দেহের মাত্রা বেড়েছে। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতেই এই দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে দলটি।
বিরোধী দলের অনুরোধ ছিল, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে তাদের দাবিদাওয়া রাষ্ট্রপতি যেন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। এতে বিরোধী দলের জন্য নির্বাচনের পথ সুগম হয়। বিরোধী দলের প্রধান দাবি নির্দলীয় সরকার, যা সরকারি দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অতিসীমিত, তা জেনেও বিরোধী জোট এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দাবিদাওয়ার মধ্যে মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিষয়টিও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সরকারি দলকে রাজি করাতে পারেন। তবে তা হবে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিরোধী দল দেশবাসীকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে যে তারা সংলাপের মাধ্যমে সংকটের নিষ্পত্তি চায়। তবে এই সাক্ষাৎ ও বৈঠক কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে বা হবে, তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ, ইতিমধ্যেই সংসদের অধিবেশন শেষ হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর মতে ‘শেষ বৈঠক’। তিনি আরও বলেছেন যে আপৎকালীন বলে বিবেচিত সময় হলে সংসদ আবারও ডাকা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। কাজেই সংসদের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি আবার সংসদ অধিবেশন ডাকতে পারেন।
এখন সবার চোখ বঙ্গভবনের দিকে। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা সীমিত, সন্দেহ নেই। তবে সংবিধানের ৪৮(৫) ধারায় কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতি কোনো বিষয় পাঠালে মন্ত্রিপরিষদ আলোচনা করতে পারে। এর পরও রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে দুই জোটের মধ্যে সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, এমনকি তিনি আলোচনায় মধ্যস্থতাও করতে পারেন। এমনটা করলে রাষ্ট্রপতি একটি ঐতিহাসিক নৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক রাষ্ট্রপতি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে দেশ সংঘাত-সংঘর্ষে জর্জরিত হোক।

চার.
লেখাটি শুরু করেছিলাম বুজকাসি আর ‘গ্রেট গেম’ দিয়ে। ইতিমধ্যেই নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার খবর, অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়তে পারে দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শুনানি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে ভারত সরকারকে কোনো পক্ষ না নিতে অনুরোধ করেছে। এককথায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
উপসংহার টানতে চাই এ মন্তব্য করে যে আমরা বুজকাসি খেলার মস্তকবিহীন মেষ হতে চাই না। চাই না দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন গ্রেট গেমের ক্ষেত্র হোক। দেশের জনসাধারণ প্রত্যাশা করে যে দুই পক্ষই যৌক্তিক ছাড় দিয়ে দেশের স্বার্থে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে । এ ক্ষেত্রে দেরিতে হলেও নির্বাচন কমিশনের উপলব্ধির সঙ্গে আমরাও একমত যে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে না। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংসদ ভেঙে, আলোচনার ভিত্তিতে, একটি ছোট আকারের সরকারের সহযোগিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত দেখতে চাই। চাই না নিশা দেশাই বিসওয়ালের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হোক।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
[email protected]