জয় হোক দুর্নীতির!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

মুঠোফোনে প্রায়ই govtinfo থেকে নানা মেসেজ আসে। ২০ নভেম্বর বেলা তিনটার দিকে এমনই এক মেসেজ পেলাম: ‘জনতার শক্তি, রুখবে দুর্নীতি’—দুর্নীতি দমন কমিশন। বিষয়টি অনেকটা তামাশার মতো মনে হলো। কারণ, সেদিনই গভীর রাতে কার্যকর হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন সংশোধনী বিল, ২০১৩। সংসদে পাস হওয়া এই বিলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি। তড়িঘড়ির কোনো ব্যাপার ছিল কি? তাহলে এত রাতে বিলে স্বাক্ষর কেন? যা-ই হোক, সরকারি কর্মকর্তারা এখন পুরোপুরি সুরক্ষিত। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই আর দুর্নীতির অভিযোগ আনা যাবে না।
এই সংশোধনী বিল যখন সংসদে পাস হয়েছে, তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দুদক এখন ‘নখ-দন্তহীন বিড়ালে পরিণত হবে।’ নখ ও দাঁত আগেও ছিল না দুদকের, কিন্তু বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা আসলেই পরিণত হলো বিড়ালে। গর্জন নয়, এখন দুদকের মিউমিউই শুনতে হবে সামনের দিনগুলোয়। দুদক সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে নিজের শক্তিতে আর যা-ই হোক, দুর্নীতি দূর করা যাবে না। জনতার শক্তিই তার ভরসা! মুঠোফোনে মেসেজ দিয়ে জনগণকে তা-ই জানিয়ে দিয়েছে।
সংশোধিত আইনের ৩২(২) ও ৩২(ক) ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আগে দুদক নিজের সিদ্ধান্তে এ কাজ করতে পারত। এতে যে দুদকের ক্ষমতা কমল, প্রতিষ্ঠানটি আরও দুর্বল হলো, এটা বুঝতে আইনবিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের আইনগতভাবে এই যে সুরক্ষা দেওয়া হলো, এর মধ্য দিয়ে বৈষম্যকেও স্বীকৃতি দেওয়া হলো। আমাদের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করছে। বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ এখন আমরা আর সে জায়গায় নেই। সরকারি কর্মকর্তারা আর আমাদের সমান নন। তাঁরা দেশের যেকোনো জনগণের চেয়ে উঁচুতে। কারণ, তাঁরা যে আইনের আশ্রয় পাবেন, সে রকম ‘সমান আশ্রয়’ পাওয়ার সুযোগ সাধারণ নাগরিকের নেই।
এ সময়ের দুটি আলোচিত দুর্নীতির ঘটনা হচ্ছে পদ্মা সেতু ও হল-মার্ক। দুটি ঘটনারই তদন্ত করেছে দুদক। কতটা স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে পারে, তার নমুনা আমরা দেখেছি। সরকারের যেমন ইচ্ছা, সেভাবেই কাজ করেছে দুদক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তদন্তের শুরুতে কিছুই পায়নি দুদক। পরে সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুদকও তার অবস্থান পাল্টেছে। সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে বাঁচানোর অবস্থানে সরকার যখন শেষ পর্যন্ত অটল থেকেছে, তখন দুদকও তাঁকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দিয়েছে। অভিযুক্ত হন সরকারি কর্মকর্তারা।
হল-মার্কের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটির মলিক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের (নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা ও পরিচয় যেখানে গুরুত্বপূর্ণ) বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা গেলেও দুদকের মামলায় তাঁরা কেউ অভিযুক্ত হননি। অভিযোগ উঠেছিল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এম মোদাচ্ছেরের বিরুদ্ধেও, বাদ গেছেন তিনিও। সরকারের ইচ্ছা ও অনিচ্ছায় এত দিন রাজনীতিক ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ‘স্বাধীন’ দুদকের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে আসছিলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সে সুযোগ ছিল না। দুদক আইনের সংশোধনী সে সুযোগ করে দিল।
এই সংশোধনীর চেষ্টা সরকার করে আসছিল দীর্ঘ দিন ধরে। বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরোধিতাও চলেছে সমানে। ফলে এ ধরনের একটি সংশোধনী করা ঠিক হবে কি না, সেটা যাচাই করতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি প্রতিনিধিদল সেই ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত ঘুরে এসেছে। এর পর তারা নিশ্চিত হয়েছে, সেসব দেশের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবেই কাজ করে এবং এই সংশোধনী পাস হলে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হবে। প্রতিনিধিদল তাদের প্রতিবেদন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত বা মামলা পরিচালনার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান সংসদে পাস করা উচিত হবে না বলে মত দেয়। কিন্তু দুদককে দুর্বল করতে মরিয়া হয়ে ওঠা সরকারকে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো গেল না। সরকার আর সংসদের মেয়াদের শেষে এই অপকর্ম তারা করেই গেল।
সংসদে এই বিল পাস হয়ে যাওয়ার পর অনেকে শেষ ভরসা মেনেছিলেন রাষ্ট্রপতিকে। টিআইবিসহ অনেকে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছিলেন এই বিলে স্বাক্ষর না করতে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা আমাদের জানা। সেদিন বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া যখন দেশের বর্তমান ‘ক্রান্তিকালে’ রাষ্ট্রপতির প্রতি ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান, তখন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘আপনারা দুই দল দুবার করে ক্ষমতায় ছিলেন। সেই সুযোগ তো রাখেননি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব যা লিখে দেন, তা-ই রাষ্ট্রপতিকে বলতে হয়।’ দুদক আইনের সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার এই দোহাই দেওয়া যায়। কিন্তু জনস্বার্থ বা নৈতিক বিবেচনা বলে কী কিছু থাকবে না? রাষ্ট্রপতি যদি বিলটিতে স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠাতে পারতেন, তবে আমরা অন্তত টের পেতাম যে জনস্বার্থকে বিবেচনায় নেওয়ার মতো অভিভাবক আমাদের রয়েছে।
ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও রাষ্ট্রপতি বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিরোধীদলীয় নেতাকে ‘সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করার আশ্বাস দিয়েছেন। বঙ্গভবন থেকে বিরোধী দলের বক্তব্য ও দাবিগুলো সরকারের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে থেকে এই কাজ করতে পারেন, তবে দুদকের সংশোধনী বিলটি ফেরত পাঠাতে সমস্যা ছিল কোথায়? রাষ্ট্রপতি বিলটি ফেরত পাঠালে সরকারের ওপর নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ত। সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে বিল পাস হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের বিধান রয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি দুদক আইনের সংশোধনী বিলটিতে স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠাতেন, তার পরও এই মেয়াদের পর রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করেছেন বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এতে অন্তত আমরা রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছার প্রমাণ পেতাম। দুদকের এই
সর্বনাশ করার দায় তিনি এড়াতে পারতেন।
দুর্নীতি হয় মিলেমিশে। আমলাদের সঙ্গে না নিয়ে রাজনীতিবিদদের পক্ষে দুর্নীতি করা কঠিন। দুর্নীতি করেও ছাড় পেয়ে যান রাজনীতিবিদেরা। রাজনৈতিক সরকারের চাপ উপেক্ষা করার শক্তি দুদকের নেই। ফেঁসে যেতেন ‘বেচারা’ আমলারা। মিলেমিশে দুর্নীতি, কিন্তু বিপদে পড়বে এক পক্ষ—এই বৈষম্য আর কত দিন! আমলা আর রাজনীতিবিদদের এই ‘বৈষম্য’ দূর করার কাজটি করেছে দুদক আইনের সংশোধনী। মিলেমিশে দুর্নীতিতে এখন আর খুব সমস্যা হবে না। নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য এর চেয়ে বড় ‘নির্বাচনী উপহার’ আর কী হতে পারে। বিরোধী দল এখন ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলনে ব্যস্ত। দুদকের এই সংশোধনী বিল নিয়ে তাদের কোনো রা নেই। ক্ষমতায় গেলে তাদেরও যে কাজে লাগবে! জয় হোক দুর্নীতির!
বাংলাদেশে যখন দুর্নীতির জয়গান গাওয়ার সব আয়োজন সারা হয়েছে, তখন আজ সোমবার পানামা সিটিতে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের সদস্যদেশগুলোর পঞ্চম অধিবেশন (সিওএসপি)। চলবে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে—এমন ১৬৮টি দেশের একটি আবার বাংলাদেশ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুধু দেশীয়ভাবেই (বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পাঁচটি অগ্রাধিকারের দ্বিতীয়টি ছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে’) নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ!
এবারের সম্মেলনের অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন বাস্তবায়ন পর্যালোচনা। আমাদের আইনমন্ত্রী, আইনসচিব (লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক) ও দুদক চেয়ারম্যান এই সম্মেলনে যোগ দিতে এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছেন। দুর্নীতি দমনে ‘অঙ্গীকারবদ্ধ’ আমাদের সরকার যে দুদককে কতটুকু ‘শক্তিশালী ও স্বাধীন’ করল, সে প্রসঙ্গ সেখানে এড়ানো সম্ভব হবে না। দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়টি নিয়ে সেখানে বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই জবাবদিহির মুখে পড়তে হবে। কী বলবেন তাঁরা কে জানে। দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে গিয়ে সম্ভবত তাঁদের দুর্নীতির জয়গানই গাইতে হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]