আজাওজা সরকার ও মহা জুয়া খেলা

আজাওজা সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এরশাদের মুখোমুখি শেখ হাসিনা
আজাওজা সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এরশাদের মুখোমুখি শেখ হাসিনা

জগতে কখনোই একই জাতীয় দুটি বা তারও বেশি ঘটনা এক রকম হয় না। স্থানবিশেষে, সময়ের কারণে এবং কাদের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত, তার ওপর ঘটনার চরিত্র ভিন্ন হয়। স্থান, কাল, পাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন মহাযুদ্ধ দুটোই, কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পার্থক্য বিরাট। যদি তৃতীয় মহাযুদ্ধ হয়, তারও চরিত্র হবে আগের দুটি থেকে অন্য রকম।
কোনো দেশের রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রেও তাই। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন এক রকম ছিল না। যদিও দুটোই ছিল একনায়কত্বের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলন। ছিয়ানব্বইয়ের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন আর ২০১৩-র আন্দোলনও এক চরিত্রের হবে না। ২০০৬-এর আন্দোলনের সঙ্গেও এবারের আন্দোলন মিলবে না। সময় ভিন্ন, পরিস্থিতি ভিন্ন, সংকটের চরিত্র ভিন্ন, সুতরাং এবারের সংকট ও তার থেকে বের হওয়ার পথও হবে ভিন্ন। সেই ‘ভিন্নতা’টা যে কী, তা এই মুহূর্তে অনুমানে বলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
পৃথিবীর গত ৮০০ বছরের ইতিহাসে বাংলার মানুষই বিচিত্র ধরনের সরকার দ্বারা শাসিত হয়েছে। শাসিত হওয়া মানে শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়া। বাংলার প্রথম উদ্দীনীয় সরকার এবং দ্বিতীয় উদ্দীনীয় সরকার দুটোই ছিল সামরিক শাসক। প্রথম উদ্দীনীয় সরকার ছিল ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির সরকার। দ্বিতীয় উদ্দীনীয় সরকার ছিল ফখরুদ্দীন-মইন উ-র সরকার। তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৮০০ বছর। কিন্তু চরিত্রগত দিক থেকে তারা ছিল একই রকম। মূলত সামরিক একনায়কত্ব।
সবশেষে বাংলাদেশে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তাকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘সর্বদলীয়’ সরকার বা ‘নির্বাচনকালীন’ সরকার। এই নামকরণ সম্পূর্ণ ভুল। এই সরকারের সঠিক নাম হলো আজাওজা সরকার (আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি-ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদ সরকার—সংক্ষেপে আ-জা-ও-জা)। সামরিক একনায়কত্ব ও বেসামরিক একনায়কত্বের মধ্যে পার্থক্য হলো কালো চুল ও সাদা চুলের মধ্যে যে পার্থক্য, তা-ই। জিনিস একই, শুধু রংটা আলাদা।
আমরা অনেক সময় শব্দের অর্থ করতে ভুল করি। একটিকে বুঝতে অন্যটি বুঝি। আম আর আমড়া যেমন এক জিনিস নয়, আতাফল ও সরিফাও এক ফল নয়। Cabinet এবং Council of ministers এক জিনিস নয়। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ আর ১৯৭১-এর ডাক্তার আবদুল মোত্তালিব মালিকের মন্ত্রিপরিষদ এক জিনিস নয়। ১৯৭৩ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিপরিষদ আর ১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রিপরিষদ দুই জিনিস। ২০০৯ সালে গঠিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদ আর ২০১৩-র নভেম্বরে গঠিত তাঁর মন্ত্রী-উপদেষ্টা পরিষদ এক জিনিস নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সরকার, সেটাই কেবিনেট। কোনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রভু হিসেবে তাঁর আস্থাভাজন বা প্রিয় কয়েকজন ব্যক্তিকে মন্ত্রিত্ব পদে নিয়োগ দিলে তাকে কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স বলা যেতে পারে, কিন্তু তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে কেবিনেট পদবাচ্য নন।
১৯৮০ ও নব্বইয়ের দশকে জাহানারা ইমাম ও আমি হপ্তায় তিন দিন বিকেলে হাঁটতে যেতাম। কোনো দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, কোনো দিন সংসদ ভবন চত্বরে। আরও অনেকেই হাঁটতেন। প্রফেসর আহমদ শরীফ খুবই নিয়মিত। একদিন খালাম্মা উল্টো দিক থেকে আসা এক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, এই লোকটি গভর্নর মালিকের মন্ত্রী ছিলেন।
হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে কিছুক্ষণ জিরাতে হতো। শরীফ স্যার উদ্যানের গোলচত্বরে বসে অনুরাগীদের সঙ্গে তর্ক করতেন। কখনো আমিও যোগ দিতাম। খালাম্মা একটুখানি দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতেন। অপারেশনের পরে তিনি বেশিক্ষণ খুব জোরে হাঁটতে পারতেন না। একদিন ওই বিশ্রামের সময় আমি ওই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি রাজনীতি করেন? বললেন, একসময় করতাম। বললাম, কখনো কি মন্ত্রী হয়েছিলেন? বললেন, হ্যাঁ। একাত্তরে মন্ত্রী ছিলাম। তথ্যমন্ত্রী। কথাটি বললেন খুব স্বাভাবিকভাবে। তাঁর মধ্যে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। আমি বললাম, ওই ভয়াবহ সময় মন্ত্রী হয়েছিলেন, কাজটা কি ঠিক করেছিলেন? তিনি খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন, কেন ঠিক করিনি, অবশ্যই ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
যা হোক, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সাধারণত যাঁরা মন্ত্রী হন, তাঁরা মনে করেন জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ঘটল। জীবন পূর্ণ হলো। মন্ত্রিত্ব চলে গেলেও অভিধাটির আগে ‘সাবেক’ কথাটি বসবে আমৃত্যু। সাবেক শব্দটি আর সরাতে পারবে না কেউ। এমনকি মৃত্যুর পরেও সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের বিয়েশাদি উপলক্ষে মন্ত্রী ছিলেন—সে প্রসঙ্গ উঠবেই। মন্ত্রিত্বের মধু বড়ই মিষ্টি মধু। এক নব মন্ত্রী (প্রথমবার মন্ত্রী) বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়েছেন।’ [সমকাল]
সর্বদলীয় সরকার নয়, আজাওজা সরকারে জাতীয় পার্টির যোগদান ও ব্যাপক প্রাপ্তিযোগে অনেক কাগজের প্রতিবেদক ও কলাম লেখকেরা কিঞ্চিৎ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আজাওজা সরকারে যোগ না দিলেই বরং তা হতো শতাব্দীর সেরা বিস্ময়। পটুয়া কামরুল হাসানকে হাজার সালাম। জীবনের অন্তিম স্কেচটির শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়া’। আজ বেঁচে থাকলে ওই শিরোনাম কেটে তিনি লিখতেন, ‘মহাবিশ্বের মেগা বেহায়া’। আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রকাশ্যে তীব্র সমালোচনা করে গোপনে রোডম্যাপের অংশীদার হয়ে পাঁচ-পাঁচটি উজির ও এক উপদেষ্টা উপহার পাওয়া শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব। তাঁর রাজনৈতিক বেইমানিতে দলের এক নেতার হূদ্যন্ত্রের বৈকল্য দেখা দিয়েছে। এবং হাসপাতালের শয্যা থেকে তিনি এক বিবৃতিও দিয়েছেন। তিনি ‘ফ্যামিলি মেম্বার’ হলেও দলের যে মেম্বার থাকবেন, সে ভরসা কম।
সম্রাট আকবরের নবরত্নের সংখ্যা ছিল নয়জন। বর্তমান আজাওজা প্রশাসনের রত্নের সংখ্যা দুটি বেশি। এগারো জন। সংখ্যা ক্রমাগত আরও যে বাড়বে না, সে গ্যারান্টি একেবারেই নেই। উপমহাদেশে ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। বাংলার মাটিতে পদ ছিটালেও লোকের অভাব হয় না। মন্ত্রিত্বের পদ হোক, উপদেষ্টার পদ হোক, সচিবের পদ হোক বা যেকোনো বড় পদ হোক—ছিটালে লোকের অভাব হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বর্তমান মহাজোট সরকার পদ-পদবি উপহার দিতে পৃথিবীর ইতিহাসেই অদ্বিতীয়।
আজাওজা সরকার শুধু বাদ রেখেছে একটিমাত্র গোত্রকে পদ ও প্রমোশন দেওয়া। সে গোত্রটি হলো উপসম্পাদকীয় লেখক। ধারণা করি, নির্বাচনের আগে আজাওজাপন্থী কলাম লেখকেরা, যাঁরা সরকারের কার্যকলাপকে সমর্থন দিয়ে হপ্তায় তিন-চারটি কাগজে কলাম লেখেন, তাঁদের দেওয়া হবে উপমন্ত্রীর মর্যাদা। অন্যদিকে যাঁরা সরকারকে সমালোচনা করে লেখেন, তাঁদের দেওয়া হবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদমর্যাদা। মুড়িমুড়কির মতো এত প্রমোশন ও পদমর্যাদা বিতরণের পর ভোট আর যাবে কোন দলে?
কিছুদিন যাবৎ আমার নিজের একটি প্রত্যয় জন্মেছে যে ১৯৮০ সালের আগে থেকে যাঁরা আওয়ামী লীগ করছেন, তাঁরা যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সরকার চালাতেন— পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছাত না। রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে। তা বাস্তবায়নের দায়িত্বটা বর্তেছে শেখ হাসিনার ওপর। তিনি তা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের বা ক্ষমতার বাইরে রাখার পূর্বপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকবে। সেই সিদ্ধান্তে উৎসাহ যাঁরা জুগিয়েছেন, কেউই আওয়ামী লীগের মূল লোক নন। স্বনিয়োজিত আওয়ামীবন্ধু। দেশের বা আওয়ামী লীগের বড় বিপর্যয় ঘটলে, তখন তাঁরা রং বদলাবেন এবং সব দোষ চাপাবেন সরকারপ্রধানের ঘাড়ে। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট থেকে আমরা তা দেখেছি।
দেশ-বিদেশের মিডিয়া ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যেই যা আলোচনা করছে, তা হলো ভারত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। বাংলাদেশের অনেক প্রখ্যাত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও তা চান। স্বনামধন্য কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকেরাও তা চান। সে লক্ষ্যে তাঁরা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে বহু ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ড করছেন। তাঁদের এককথা: শেখ হাসিনার সরকার না থাকলে বাংলাদেশ আধুনিক, ডিজিটাল, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল থাকবে না।
অন্যদিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি মনে করে, তারা অল্প আধুনিক, অল্প মাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষ ও অল্পস্বল্প প্রগতিশীল থাকবে—তাতেই বা তাদের দোষ দেব কেন? ঘাড় ধরে কোনো জনগোষ্ঠীকে সেক্যুলার, আধুনিক ও প্রগতিশীল করা সম্ভব নয়—যদি না তারা নিজেরা তা না হয়ে ওঠে।
আজাওজা সরকার একটি সুপরিকল্পিত সরকার। এখনো সময় আছে। আগামী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ আছে। একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে যদি এই বর্তমান প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে—ইতিহাসে তার জায়গা হবে একরকম। তা না হলে আজাওজা প্রশাসনই যদি টিকে যায়, তাহলে মানুষ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে প্রশাসক হিসেবেই অভিহিত করবে।
বিএনপির নীতি-আদর্শ কী জানি না। তাদের যোগ্যতা-দক্ষতা সম্পর্কেও আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। মহাজোটের প্রতি বিরূপতা থেকে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তা হতে পারে। সরকারের মনোবাসনা পূরণ করে যদি তারা নির্বাচন বর্জন করে, তা হবে আজাওজা সরকারের জন্য মহা আনন্দের। তখন যে নির্বাচন হবে, তাতে বিশেষ কারচুপির প্রয়োজন হবে না। নির্বাচন কমিশনও কিছু ঝামেলা
থেকে বাঁচে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সময়টি ক্লাইভ-মীর জাফরের সময়ের চেয়ে ভালো—এ কথা যাঁরা প্রচুর উপসম্পাদকীয় রচনা লেখেন, তাঁরা বিশ্বাস করলেও আমার মতো নাদান বিশ্বাস করে না। সম্ভবত কিছু বিশিষ্টজন ছাড়া জনগণের একটি বিরাট অংশও বিশ্বাস করে না। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, দেশের বিখ্যাত বিদ্বানদের একটি অংশ যদি দাসত্বকেই স্বাধীনতা ও যুক্তি মনে করেন, তখন জনগণের দুঃখের আর শেষ থাকে না।
বাংলাদেশকে নিয়ে একটি ‘গ্রেট গেম’ বা মহা জুয়া খেলা চলছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সেই জুয়ার একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে। আজাওজা মহাজোট ওই জুয়া খেলায় না জড়ালেই পারত। দেশ আজ আর জনগণের অধিকারে নেই। বাংলাদেশকে আবার ঠিক জায়গায় আনতে জনগণকে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তা কেউ জানে না। তবে এ কথা ধ্রুব সত্য যে, কোনো জনগোষ্ঠীকে খুব বেশি দিন ‘দাবায়ে রাখতে’ পারে না কোনো শক্তি। হেমন্ত ও শীতের পরে সব জনপদেই বসন্ত আসে। বাংলার বসন্তও খুব বেশি দেরিতে আসবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।