'দলে দলে কলাগাছে ভোট দিন'

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

‘আপনারা দলে দলে কলাগাছে ভোট দিন’ এটাই মনে হচ্ছে ইদানীংকালের আওয়ামী লীগের উদাত্ত আহ্বান— ভোটারদের প্রতি।
বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরাসরি কলাগাছকে ভোট দিতে বলা হচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সভায় যা বেশ কয়েকবার বলেছেন, এর মর্মার্থ হলো আওয়ামী লীগ যে আসনে যাঁকেই মনোনয়ন দেবে, নেতা-কর্মীদের উচিত হবে প্রার্থী ভালো কী মন্দ—সে বিতর্কে না গিয়ে ভোটারদের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং নিজেরাও নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া।
এ ধরনের অতি মূল্যবান ‘দিকনির্দেশনা’র কারণ খোঁজা বা বোঝা জটিল কাজ নয়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ২,৬১১টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। যাঁরা একাধিক মনোনয়নপত্র নিয়েছেন, তাঁরা শুধু একটির মূল্য পরিশোধ করেছেন, নাকি যতগুলো ক্রয় করেছেন প্রতিটির জন্য আলাদাভাবে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন, সে খবর চোখে পড়েনি। তবে ২৫ হাজার টাকা হারে ২,৬১১টি মনোনয়নপত্রের জন্য জমা হওয়ার কথা সাড়ে ছয় কোটি টাকার অনেক বেশি।
অবশ্য টাকাপয়সা বড় কথা নয়। অঙ্কের হিসাবে ৩০০ আসনের জন্য এতগুলো মনোনয়নপত্র বিক্রি হওয়া মানে আসনপ্রতি আটজন মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থী। মনোনয়ন পাবেন একজন। তাই গোসসা করবেন বাকি সাতজন। শেষ পর্যন্ত যাঁরা মনোনয়ন পাবেন না, তাঁরা বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন কি না, সেটা সময়ের ব্যাপার। তবে মনোনয়ন পাওয়া ৩০০ প্রার্থীর বাইরে মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে যাওয়া নেতা-কর্মীর সংখ্যা হবে দুই হাজারের বেশি।
তাই শেখ হাসিনার আহ্বান— কে প্রার্থী হলো বা হলো না, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো নৌকা। মার্কা একটাই—নৌকা।
গত চার দশকের নির্বাচনগুলোতে মার্কায় ভোট হয়েছিল দুবার। অর্থাৎ ভালো-মন্দনির্বিশেষে শুধু দলীয় বিবেচনায় বেশির ভাগ ভোটার নৌকায় ভোট দিয়েছেন ১৯৭০ আর ২০০৮ সালে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের কতটা আসল আর কতটা নকল, সেটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবু ধারণা করা যায় যে ওই নির্বাচনেও সম্ভবত বেশির ভাগ ভোট পড়েছিল মার্কা বিবেচনায়, প্রার্থী বিবেচনায় নয়। ভোট পড়েছিল ধানের শীষে।

২.
এটা এখন স্পষ্ট যে কে মনোনয়ন পাবেন আর কে পাবেন না, সেটা নির্ভর করবে দলীয় সভানেত্রীর ইচ্ছার ওপর। মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে ঢাকা থেকে। স্থানীয় পর্যায় থেকে মনোনয়নপত্র কেনাবেচা বা জমা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভূত হয়নি।
গত নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায় থেকে পাঁচজন প্রার্থীর নাম পাঠানো লোক দেখানো হলেও একটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এবার মনে হচ্ছে সেটাও নেই। স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কিছু বৈঠক নিঃসন্দেহে হচ্ছে। কিন্তু এসব বৈঠকের মর্মবাণী হচ্ছে, আমি যাঁকে মনোনয়ন দেব, আপনারা তাঁকেই ভোট দেবেন এবং এলাকার ভোটাররা যাতে তাঁকেই ভোট দেন, সেটার জন্য কাজ করাই স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একমাত্র কাজ।
এটা তো গণতন্ত্র হতে পারে না। প্রতিষ্ঠার ৬৫ বছর পরও যদি একটি রাজনৈতিক দল প্রায় সম্পূর্ণভাবে এক ব্যক্তির খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল থাকে, তাহলে সেই দলকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বলবেন, না এক ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বলবেন, সেটাই বিবেচ্য। অবশ্য এ অবস্থা যে শুধু শেখ হাসিনার দলের, তা নয়। জাতীয় পার্টির অবস্থা তো আরও করুণ। দলের নেতা সকালে কী বলবেন আর বিকেলে কী বলবেন, সেটা তিনি না বলা পর্যন্ত কিন্তু কেউ জানতে পারে না।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, দলের কে প্রার্থী হবেন বা না হবেন, সেটা যখন এক ব্যক্তির ইচ্ছা বা বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করে, তাহলে যাঁরা প্রার্থী হতে চান, তাঁরাই বা এমন দলের সদস্য-নেতা কেন? তাঁরা কি কোনো নিয়মতান্ত্রিকতা বা গণতন্ত্রের রেওয়াজ চর্চা চান না? অনুমান হয়, তাঁরা এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন।
এ সপ্তাহে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন—মহীউদ্দীন খান আলমগীর, দীপু মনি, সাহারা খাতুন, ড. আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। তাঁরা অন্য যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক নেতা হলে এভাবে মন্ত্রিত্ব হারানোর পর নির্বাচনের জন্য আর মনোনয়নপত্র চাইতেন না। প্রায় পাঁচ বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার পর আর কী বড় পদ বা মর্যাদা চাওয়ার থাকতে পারে; বা দুই দফা মন্ত্রী থাকার পর (১৯৯৬তে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আর এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং চাকরিজীবনে সচিবের মতো প্রজাতন্ত্রের কর্মে সর্বোচ্চ পদ) আর কী চাওয়া বা পাওয়ার থাকতে পারে।
আমাদের রাজনীতিতে চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই কেন? সম্ভাব্য উত্তর হলো, যাঁরা ‘রাজনীতি করেন’, তাঁরা আর অন্য কিছু করতে পারেন না। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ও ড. কামাল হোসেনের মতো নেতারা বিশাল আইনজীবী। আইনজীবী পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তি, যাঁরা রাজনীতি করতেন সম্পূর্ণ আদর্শগত তাড়নায়। তাঁদের মতো স্থানীয় পর্যায়ে যুগ যুগ ধরে বহু নেতা-কর্মী আছেন, যাঁদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার মূল কারণ হলো আদর্শগত বিশ্বাস এবং পরোপকার করার বাসনা।
কিন্তু এই ঘরানার লোকজন এখন ‘বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি’র শ্রেণীভুক্ত। ছোটবেলায়, ষাটের দশকে সুন্দরবনের ভেতরে নদী-খালে স্টিমারে বসে পানির ধারে সন্ধ্যায় বিরাট বিরাট বেঙ্গল টাইগার দেখেছি অনেকবার। মোহিত হয়েছি, ভীত হয়েছি, শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। তখন ‘বাঘ’ শব্দটিও উচ্চারণে মানা ছিল। বলতে হতো—ওই যে গাছের আড়ালে ‘মামা’। এখন সেই বনও নেই, সেই জাঁদরেল বাঘও বিলুপ্তপ্রায়। মাত্র নাকি শ-চারেক। তা-ও শীর্ণ-দীর্ণ। পারলে বনের আশপাশের মানুষের রান্নাঘরে রান্না করা মুরগির জন্য বা ছাগলের ছানার জন্য হানা দেয়।
৩.
বন রক্ষার তাগিদ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ এবং ‘ফেয়ার প্লে’র বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা। কলাগাছকে কেউ আর গাছ এখন মানবে না। তাই শেখ হাসিনাকে পিছে ফেলে আমরা সম্ভবত এগিয়ে গিয়েছি। এককভাবে কলাগাছকে মনোনয়ন দেবেন আর দলের লোকজন কোনো বাছবিচার না করে ‘মার্কা’য় ভোট দেবেন, সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অন্য প্রধান দলের অবস্থা সম্ভবত আরও করুণ। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের বার বিল্ডিংয়ের বারান্দায় এক বিরাট ‘বার্থডে কেক’ রাখা ছিল ঢাউস এক টেবিলের ওপর। ষাট, সত্তর, এমনকি দু-চারজন আশি-ঊর্ধ্ব আইনজীবী সেই কেক খাচ্ছিলেন। বিলেতের রানি এলিজাবেথেরও সম্ভবত এ রকম সৌভাগ্য হয় না। অর্থাৎ রানির জন্মদিনে ওই দেশের বড় আইনজীবীরা ঘটা করে প্রকাশ্যে কেক কেটে খান না। তারপর পত্রিকায় খবর পড়লাম—ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন। বইয়ের নাম তারেক রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা বা সে গোছের কিছু।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর কথা। তখনো ওয়েব বা ইন্টারনেটে তথ্য পাওয়া যেত না। তথ্যসংক্রান্ত অনেকগুলো বই থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম—তখন পর্যন্ত বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে শ-চারেক পিএইচডি থিসিস লেখা হয়েছিল—তাঁর রাজনীতি, দর্শন, কর্ম, ধর্মবিশ্বাস, অহিংস আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত কোনো পিএইচডি থিসিসের হদিস পাইনি।
তারপর গত ২০ বছরের খবর কি কেউ রেখেছেন? নাকি এখন তারেক রহমানের ওপর পিএইচডি গবেষণায় নামতে হবে!

৪.
নষ্ট রাজনীতি এখন ভোট চাওয়া-চাওয়িতেই সীমাবদ্ধ। তা-ও আবার সুষ্ঠুভাবে, অর্থাৎ সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশীদারিমূলক নির্বাচনও আয়োজিত হচ্ছে না। মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীগুলোর মতো এখন হয় কলাগাছে ভোট, না হয় লাঠালাঠি। যারা নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা, মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে আইনসংগত পথে আয়-উপার্জন করতে পারে না, তাদের হালুয়া-রুটির যে পন্থা, সেটাই এখন রাজনীতি, সেটাই এখন নির্বাচন।
এসবের শেষ চাই। আজই, এখনই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।