তনু থেকে পয়লা বৈশাখ

গত বছর বর্ষবরণের দিনে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষার্থীরা
গত বছর বর্ষবরণের দিনে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষার্থীরা

ভাবতে অবাক লাগে, অপরাধীদের ধরা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা দিনের পর দিন কী নির্লিপ্তভাবে বোকা বোকা চেহারায় হাসিমুখে বানানো কথা বলে যেতে পারেন। চোখেমুখে অপরাধী কোনো ভাব কি কখনো দেখা যায়? মুহূর্তের জন্য হয়তো আসতেও পারে। হাজার হলেও মানুষ তো! ত্বকী, সাগর-রুনি, অভিজিৎ, দীপন, তনু, সর্বশেষ নাজিম, বহুল আলোচিত হলেও ভণিতা চলে নির্দ্বিধায়। আর যেসব খুনের ঘটনা বড়জোর এক বা দুই দিন পত্রিকার পাতায় আসে বা কখনোই আসে না, সে সব নিয়ে তো প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া গ্রেপ্তার, আটক, তুলে নেওয়া, এমনকি আটকাবস্থায় খুন করে ক্রসফায়ারের একঘেয়ে অসত্য গল্প তো চলতেই থাকে। নাটকের স্ক্রিপ্ট খুব চেনা, খুব দুর্বল।
সে জন্যই যাঁদের ঘোষিত দায়িত্ব দুর্বৃত্ত দমন করা, বাস্তবে তাঁদের ভূমিকা দেখা যায় পুরো উল্টো। সহিংসতা, খুন, যৌন-সন্ত্রাস, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, দখল, দুর্নীতি ইত্যাদিতে তাঁদের প্রধান কাজ দেখি অজুহাত তৈরি করা, ভুয়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া, দুর্বৃত্তদের পক্ষে সাফাই গাওয়া ও বিভ্রান্তি তৈরি করা, ঘটনা অস্বীকার করা, প্রমাণ নষ্ট করা, তদন্ত কমিটি নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা, রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া এবং সবকিছু মিলিয়ে দুর্বৃত্তদের রক্ষা করা। এর থেকে বিচ্যুতি ঘটে তখনই, যখন প্রতিবাদ ও জনপ্রতিরোধ তৈরি হয়, এবং যখন তা ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়।
বাঁশখালীতে গরিব, নিরস্ত্র, নিরন্ন মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা। এখন পুলিশ মামলা করেছে সেই হতাহতদের গ্রামের জানা-অজানা তিন হাজার মানুষেরই বিরুদ্ধে। তার পরের ঘটনাগুলো কী ঘটবে, তা সবাই জানেন। কতজন ফেরারি হবে, ঘরে ঘরে কত কী বেচতে হবে, নিরীহ কতজনের জীবন অতিষ্ঠ হবে—তা কে বলতে পারে? জ্বালানি উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সরকারের পূর্ণ সমর্থন আছে এই কোম্পানির প্রতি। সেটা আমরা বরাবরই জানি।
গত পয়লা বৈশাখে যারা যৌন-সন্ত্রাস চালিয়ে উৎসবকে বিষাক্ত করেছিল, আরেক পয়লা বৈশাখ এসে গেলেও, তাদের ধরতে পারল না পুলিশ, নির্লিপ্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। দেশে কিছু ঘটলেই সিসিটিভি কেনার বাণিজ্য বাড়ে। এই এলাকায় অনেক সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল, সেগুলোতে দুর্বৃত্তরা শনাক্ত হওয়ার পরও প্রথমে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টিকেই অস্বীকার করতে চেয়েছে, আন্দোলনের চাপে পরে স্বীকার করলেও, হাস্যকর কিছু নড়াচড়া করা ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেননি তাঁরা। পারেননি তাদের চিনতে পারছেন না বলে নয়, আমরা বুঝি, চিনতে পেরেছেন বলেই তাদের ধরা ‘গেল না’। বিশ্ববিদ্যালয়ে পার পেয়ে গেছে, এখন ওই দুর্বৃত্তরা কিংবা তাদের সমমনারা তো নিশ্চিন্তে অন্যত্র হামলা চালাতে থাকবেই। সমতল থেকে পাহাড়ে। পাহাড়ে অপহরণ-ধর্ষণ করে যদি অপরাধী পার পেয়ে যায়, তারা সমতলেও চালাবে এই অপরাধ। সংখ্যালঘুর ওপর হামলা করলে যদি সবাই চুপ থাকে, তাহলে হামলা সংখ্যাগুরুর ওপরও আসবে।
প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আমরা পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের বিপন্নতার খবর দেখি। ঢাকা শহরে দিনে-রাতে শিফট ভাঙার সময় দলে দলে তাঁদের দ্রুত হাঁটার দৃশ্য আমাদের খুব পরিচিত। দলেবলে এবং দ্রুত হাঁটার আরেকটা কারণ হলো পথেঘাটে অজস্র লোভী চোখ, হাত-পা, কটূক্তি এবং সর্বোপরি সরাসরি আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা। কিন্তু রক্ষা তাঁরা পান না। চারদিকে দুর্বৃত্ত ক্ষমতাবানদের দাপট। প্রায়ই ওই মিছিল থেকে ছিটকে পড়া ত্রস্ত কিশোরী শিকার হয় দানবদের। উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। নারকীয় নির্যাতনেও অনেক সময় ঘটনার শেষ হয় না। কোথাও আগুনে পুড়িয়ে, কোথাও অ্যাসিড মেরে, কোথাও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, কোথাও ছুরি মেরে খুন করা হয় প্রমাণ শেষ করে দেওয়ার জন্য। এগুলোর মধ্য থেকেই আমরা কিছু খবর খুবই ছোট আকারে কোনো কোনো সংবাদপত্রে দেখি, অনেক খবর কখনোই পত্রিকায় আসে না। তারপরও প্রায় প্রতিদিনই একটা-দুটো খবর থাকেই।
পোশাকশ্রমিকদের চেয়ে একটু ভালো সামাজিক অবস্থানে আছেন সেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের অবস্থাও ভিন্ন নয়। কিছু কিছু পত্রিকায় আসে, বেশির ভাগই আসে না। পথেঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে অবিরাম যে যৌন নিপীড়ন বা শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটছে, সেগুলো অনেক মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছে, অনেক মেয়ের কর্মজীবন বিপন্ন করছে, অনেক মেয়ের চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ছে, অনেক মেয়ের পোশাক বদলে যাচ্ছে; তবু রক্ষা হয় না। এর আগে মহিমা, রুমীসহ বহু কিশোরী–তরুণীর নাম পত্রিকার পাতায় এসেছে। যারা লেখাপড়া বা কাজ করার জন্য পথে বেরিয়েছিল। পথ থেকে দুর্বৃত্তের হাত এসেছে ঘর পর্যন্ত। আত্মহত্যা করে জীবনের আরও বহু ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে এই মেয়েরা। দুর্বৃত্তরা আছে বহাল তবিয়তে।
পয়লা বৈশাখে যৌন-সন্ত্রাসীদের ধরা যায়নি, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে, প্রতিবাদী নারী কর্মীদেরও নিপীড়ন করেছে পুলিশ। এর পরে বহু স্কুলের ছাত্রী, পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, অভিজিৎ, ওয়াশিকুরের পর অনন্ত, দীপন খুন হয়েছেন, ধর্মীয় জাতিগত এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, নারী নির্যাতন চলেছে, শহরে-গ্রামে চাঁদাবাজি, দখল-সন্ত্রাস বেড়েছে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা মানব পাচার চক্রের শিকার হাজার মানুষের আহাজারি প্রকাশিত হয়েছে, সরকারি দলের মধ্যে অর্থসম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি, খুনোখুনি বেড়েছে, ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে খুন অব্যাহত থেকেছে।
খুন হলে খুনি ধরা হবে না, যৌন-সন্ত্রাস হলে সেই সন্ত্রাসীকে আড়াল করা হবে, দখল-লুণ্ঠন করে দখলদারের আওয়াজ বাড়বে,
মানব পাচারের ঘটনা প্রকাশিত হলে ক্রসফায়ারে কজনকে হত্যা করে আড়াল করতে হবে গডফাদারদের—সেটাই এখন শাসনব্যবস্থার পরিষ্কার কথা।
সরকার পরিবর্তনে এই গতিধারায় কোনো ছেদ পড়ে না। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও অ্যাসিড-সন্ত্রাসসহ নানা সহিংস ঘটনার পর নারীকেই ঘরে ফেরার উপদেশ শুনতে হয়। কিন্তু ঘরে এসে তার নিরাপত্তা কোথায়? বেশির ভাগ আক্রমণ তো ঘরে এসেই ঘটে। সে জন্য নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা এলাকাতেও এই অপরাধ থামে না। ক্ষমতার যোগাযোগেই যে দুর্বৃত্তদের বর্বরতার সর্বশেষ শিকার তনু, তা সরকারের টালবাহানা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। শিকার আসলে আমরা সবাই, এই বোধটুকু ছাড়া তনুরা কীভাবে বাঁচবে, আমরা কীভাবে বাঁচব? এই বোধই আমাদের রক্ষা করে।
১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিল পুলিশ। এ ঘটনার প্রতিবাদে মানুষের জাগরণ ঘটেছিল দিনাজপুরে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সাতজন মানুষ। তাতে প্রতিবাদ থামেনি। কালিহাতীতেও নারীর অপমান ও নির্যাতন গ্রামের মানুষকে প্রতিবাদী করেছে, পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়েছেন তিনজন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এই দেশ নির্যাতক, দুর্বৃত্ত আর তাদের রক্ষাকারীদের দাপটে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়, আবার প্রতিবাদী বিদ্রোহী মানুষের প্রাণের চিত্কারে মাঝেমধ্যে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু অনেক মূল্য দিতে হয় বারবার!
এবারও ছাত্রী ও থিয়েটারকর্মী তনু হত্যার প্রতিবাদে স্কুল-কলেজ, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, সেটাই আমাদের ভরসা দেয়। সর্বত্র অনিশ্চয়তার মধ্যেও পথে, কাজে, উৎসবে, শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে; সেটাই নারীর শক্তি, আমাদের শক্তি। গত পয়লা বৈশাখের উৎসবে হামলাকারী যৌন-সন্ত্রাসীদের ধরতে ব্যর্থ কিংবা অনিচ্ছুক কর্তৃপক্ষ কোনো রকম লজ্জার ধার না ধেরে, উল্টো বুক ফুলিয়ে সমাধান দিচ্ছেন উৎসব সংকুচিত করে। তাহলে তাঁদের দরকার কী? তাঁরা কখন কোথায় কাদের নিরাপত্তা দিতে সর্বজনের অর্থ ওড়াচ্ছেন?
আসলে সমাধানের পথ সরকার গৃহীত পথের ঠিক উল্টো। উৎসবে যখন দুর্বৃত্তরা হামলা করে, আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়, তখন এর সমাধান আরও দলে দলে উৎসবে শামিল হওয়া, দিনে-রাতে। কথা বলা বা লেখার কারণে যখনই আঘাত আসে, তখন আরও সরব থাকা, আরও লিখে যাওয়াই শক্তি অর্জনের পথ। সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও প্রধান উপায় সর্বত্র নারীর সক্রিয় উপস্থিতি আরও বাড়ানো। উৎসব, জমায়েত, মিছিল, সংগঠন, পথ, হাট, মাঠ, সাইকেল, মোটরসাইকেল, বাস সর্বত্র। যদি আত্মরক্ষার জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হয়, যদি হাত-পা চালাতে হয় তবুও। দিনে-রাতে নারী-পুরুষ সবাই বের হবে, দরকারে কিংবা অদরকারে, আনন্দে কিংবা কষ্টে। শুধু বের হতে পারবে না যৌন-সন্ত্রাসী, লুটেরা আর ক্ষমতা-রোগে আক্রান্ত অসুস্থ লোকজন। পথঘাট, কর্মস্থল, শিক্ষাঙ্গন, জীবন ও সম্পদ, উৎসব—সবই সত্যিকারের মানুষের দখলে আনতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]/[email protected]