মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা

কিন্তু আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন যশোরে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ১৫ দল, ৭ দল, ৫ দলের রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো যশোরেও সে আন্দোলনে শামিল হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। যশোরের সব সাংস্কৃতিক সংগঠন এক কাতারে শামিল তখন। আর এই কাজে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করল যশোরের অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যশোর ইনস্টিটিউট। অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলেও যশোর ইনস্টিটিউট যশোরে প্রগতিশীল রাজনীতির আঁতুড়ঘর। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল হাসিবের নেতৃত্বে যশোরের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যশোর ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে যূথবদ্ধ তখন।

যশোরে শিল্পী এস এম সুলতানের অনুপ্রেরণায় কয়েকজন তরুণ চারুশিল্পী গড়ে তোলেন চারুপীঠ। উদ্দেশ্য, শিশুদের চারুশিল্পে শিক্ষাদান। যশোর ইনস্টিটিউট প্রথমে পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ শুরু করে। দুই বছরের মাথায় চারুপীঠের ঠিকানা হয় জলকলে, পৌর পার্কের পাশেই যশোর পৌরসভার পরিত্যক্ত ভবনে। চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল হাসিব। যশোরবাসীর সহযোগিতা চেয়ে তিল তিল করে তিনি গড়ে তুলছেন এই প্রতিষ্ঠান। সার্বক্ষণিক কর্মী স্বপ্নচারী দুই তরুণ শিল্পী মাহবুব জামিল আর হিরন্ময় চন্দ। দুজনই ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সবে লেখাপড়া শেষ করেছেন। সব কাজে সর্বক্ষণ লেগে থাকেন সৈয়দ মাহমুদ আলী। অধ্যাপক আবদুল নঈম, বিমল রায় চৌধুরী, কাজী রবিউল হক প্রমুখ পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

১৯৮৭ সাল। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মাহবুব আর হিরন্ময় স্বপ্ন দেখেন নতুন এক বর্ষবরণের। প্রথাগত ধারণার সঙ্গে তার কোনোই মিল নেই। উদীচীর পৌর পার্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের এবারের আয়োজন ভিন্ন। শহর সাজানো হলো নানা রঙের ফেস্টুন, পতাকায়। এক সপ্তাহ আগে থেকেই শহরজুড়ে সাজসাজ রব, উৎসবের আমেজ। সার্বিক সমন্বয়ের কাজ করল যশোর ইনস্টিটিউট। সেখানে যশোরের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে। তারা পৌর পার্ক থেকে বের করবে এক আনন্দ শোভাযাত্রা। এ শোভাযাত্রার পুরোভাগে চারুপীঠ। নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সে শোভাযাত্রায় শামিল সব সংগঠন। পৌর পার্ক থেকে বের হয়ে দড়াটানা, চৌরাস্তা হয়ে শেষ হবে যশোর ইনস্টিটিউটের মাঠে (টাউন হলে)। আয়োজন বিশাল।

শোভাযাত্রার জন্য তৈরি হলো নানা রঙের মুখোশ, নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। মঙ্গল যাচনা করা হলো। ছিল ঢোল, খোর-করতালের আয়োজনও। কণ্ঠে কণ্ঠে মঙ্গলসংগীত। সমাজের সব স্তরের মানুষ, ধর্ম-বর্ণ-বয়স-নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রা পেল সর্বজনীনতার মর্যাদা। নেচেগেয়ে যশোরবাসী এই প্রথম অন্য রকম এক পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করল। সব সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করল সংগীতানুষ্ঠানের। সর্বত্র লুচি আর মিষ্টি। বিকেলেও সংগীতায়োজন হলো যশোর ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। মঞ্চস্থ হলো নাটক। শিশুরা অংশ নিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়। সে সঙ্গে বসল লোকজ মেলা। যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির বইমেলা। আয়োজন ছিল লাঠিখেলার। সব মিলিয়ে এক সুন্দর অনুষ্ঠান। এভাবে হালখাতা-সর্বস্ব পয়লা বৈশাখ রূপান্তরিত হলো সর্বজনীন উৎসবে।

বাংলাদেশে এক নতুন বর্ষবরণের সেই শুরু। মঙ্গল শোভাযাত্রা অচিরেই দেশের সব মানুষের নজর কাড়ল। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজন করল বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা। যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলে। কিন্তু আকৃতিতে বিশাল। তারপর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উৎসবে সারা বাংলাদেশে নতুনরূপে বর্ষবরণ। এই বর্ষবরণ উৎসবই একদিন বাঙালির প্রকৃত উৎসবে পরিণত হবে। এখানেই বাঙালি খুঁজে পাবে তার আপন ঠিকানা।

আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।