আবার কালো সোমবার!

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের ভাষণে ‘সংবিধান রক্ষার’ অঙ্গীকার ২০০৬ সালের নভেম্বরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সাধারণভাবে সমঝোতার কথা বললেও তাঁর ভাষণে স্পষ্ট যে বিএনপির অংশগ্রহণের আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সাহস দিয়েছেন। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আবার প্রকারান্তরে নির্বাচনী যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বানের সুরও চাপা রাখেননি। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘দেশের ঋণ শোধ করার ডাক এসেছে।’

২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর এক কৃষ্ণ সোমবারেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালেও আরেকটি কৃষ্ণ সোমবারে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হলো। দুই পরিস্থিতির দুটি সুর অভিন্ন। প্রথমত সংবিধান রক্ষা। দ্বিতীয়ত বয়কটকারী দলের প্রতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান।

শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে দুবার নাজেহাল করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া নাকি তা একটিবার ফিরিয়ে দিতে চান। আজ থেকে তার ক্ষণগণনা শুরু হলো।

শেখ হাসিনাকে ইয়াজউদ্দিনে পরিণত করতে চাইবে বিএনপি। ইয়াজউদ্দিনের উপদেষ্টারা দুই প্রধান নেত্রীর কাছে ছোটাছুটি করতে পেরেছিলেন। এবারের মন্ত্রীরা তা করবেন না। পারবেন না। নির্বাচন করতে নয়, এই মন্ত্রিসভা যেন দেশ চালাতে এসেছে।

ইয়াজউদ্দিন তবু আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে মন্ত্রীদের সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি করেছিলেন। এবার সেটি হচ্ছে না। সংলাপ ও সমঝোতার জন্য নিশ্চয় তফসিল বাধা হবে না। প্রয়োজনে তফসিল পরিবর্তন করা যাবে। নির্বাচনের তারিখ পেছানো যাবে। কিন্তু সে রকম কোনো পরিবেশ রাজনীতিতে এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে মানুষের আশার সলতে জ্বলবেই।

সিইসি গতকাল দৃশ্যত অসততা ও অস্বচ্ছতার পরিচয় দিলেন। কারণ, আকস্মিকভাবে সমঝোতার বিষয়ে তিনি যৎসামান্য আগ্রহ দেখালেন। তিনি তাঁর ভাষণে সমঝোতা প্রশ্নে যা বললেন তা গতানুগতিক ও যান্ত্রিক। বিচারপতি কে এম সাদেক ও এম এ আজিজও নামকাওয়াস্তে সমঝোতা চেয়েছিলেন। কিন্তু একতরফা নির্বাচন করাই ছিল তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। এবার তৃতীয়বারের পালা।

বনানী বৈঠক মির্জা ফখরুল স্বীকারই করলেন না, সিইসি লুফে নিলেন। বললেন, সমঝোতার অপেক্ষায় আছেন। সমঝোতা প্রশ্নে তিনি এর আগে ‘২৪ জানুয়ারির পরও’ নির্বাচন করার কথা বলেছিলেন। অথচ এবারে তাঁর অপেক্ষার প্রহর ২৪ ঘণ্টায় ফুরিয়ে গেল। বলেছেন ঢের অপেক্ষা করেছেন। আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়। সবারই জানা এত দিন রকিব কমিশনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ছিল না। ২৭ অক্টোবরের পর আরপিও সংশোধন হয়েছে।

ভাষণে তাঁর দায়সারা দিকটি স্পষ্ট। দায়িত্বভার নেওয়ার পর সমঝোতা প্রশ্নে তিনি প্রকাশ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্য উদ্বেগ প্রকাশেও সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।

আজিজ একজন অসত্য ভাষণকারী হিসেবেও নিন্দিত হয়েছিলেন। তবু তিনি বিএনএফ পয়দা করেননি। সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে ইসির দ্বারা বিএনপির মাজা ভাঙতে গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল। বিএনএফ কি তারই ধারাবাহিকতা?

মো. শাহ নেওয়াজ গত সপ্তাহান্তে সোমবারই তফসিল ঘোষণার কথা বলেছিলেন। এরপর শনিবার বনানীতে রাত্রিকালীন নাটক হলো। রোববার তাঁরা চাইলেও তফসিল ঘোষণা করতে পারতেন না। আচরণবিধি প্রজ্ঞাপন আকারে চূড়ান্ত হয়েছে রোববার মধ্যরাতে। তাই বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সমঝোতার জন্য অপেক্ষার’ বিষয়টি বলার হয়তো একটা ফাউ সুযোগ নিয়েছিলেন সিইসি। তফসিল ঘোষণা করার আগে তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনার প্রয়োজন মনে করেননি।

রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিল বিরোধী দল। তারা সংলাপের উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানায়। মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে সংলাপে নয়া মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাউকে একটা ফোন করতেও দেখা গেল না। সিইসি তফসিল ঘোষণা করে বসলেন।

২০০৬ সালে সংকটের শুরুতে শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। এখন খালেদা জিয়াও তা-ই চাইছেন। আবার আজিজ কমিশন ভোটের আগে সেনা মোতায়েন প্রশ্নে যে মনোভাব দেখিয়েছিল, রকিব কমিশনও তেমন আভাস দিচ্ছে।

সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর একটা বিরাট ঝোঁক থাকবেই। সিইসি গতকাল তা স্পষ্ট করেছেন। অবশ্য গোড়াতে তাঁরা অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। সরকারও নারায়ণগঞ্জে সেনা দেয়নি। আর সিইসি গতকাল বেশ লক্ষণীয়ভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে ‘দেশের অতন্দ্র প্রহরী ও জনগণের আস্থাভাজন’ হিসেবে সম্বোধন করলেন।

খালেদা জিয়াও সেনা দিয়ে বিরোধী দলকে সামলাতে চেয়েছিলেন। গোপনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। চুপিসারে শঠতার সঙ্গে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। বিএনপির মদদে ইয়াজউদ্দিনের সেটাই ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপ। উপদেষ্টারা এ জন্য পদত্যাগ করেছিলেন। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়েছিল। শেখ হাসিনার সেদিনের আহ্বানের মতো খালেদা জিয়া সম্ভবত একই বাক্য উচ্চারণ করবেন। ‘সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবেন না’, ২০০৬ সালের ১১ নভেম্বর এই ছিল প্রথম আলোর একটি শিরোনাম। সাত বছরের ব্যবধানে ওই শিরোনাম হয়তো ফিরে আসছে।

সমতল খেলার মাঠ তৈরির কথা বললেন সিইসি। এর আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিলেন রাশেদ খান মেনন। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে বলেছিলেন ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে। মেরুদণ্ডহীন সিইসি এ ব্যাপারে তাঁর নিয়োগকর্তা সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপে যাননি। অথচ দিব্যি তিনি সাংসদদের গতকাল শুধু স্কুল কমিটি সভা থেকে বিরত থাকতে বললেন। লাভজনক পদ বিবেচনায় সাংসদদের মনোনয়নপত্র বাতিলের পক্ষে কমিশনের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এসেছিল। সেটাই বৈধ। এখন দেখা গেল তিনি তা উচ্চারণ করা থেকে ভুলে গেলেন।

রকিব কমিশনকে কখনো স্বাধীন মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সামান্যতম বিব্রতকর হতে পারে, এমন কোনো উক্তিও সিইসি উচ্চারণ করতে অপারগ থেকেছেন।

তফসিল ঘোষণার আগে ইয়াজউদ্দিনের চেয়েও খারাপ নজির স্থাপন করলেন বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পেয়ে কিছু লোক দেখানো কাজ করে হলেও সম্ভাব্য নির্বাচন বর্জনকারীদের আস্থা অর্জন করতে চেয়েছেন। নয় সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল ও ১৮ সচিবের দপ্তর পরিবর্তন করেন। তদুপরি আমরা বলেছিলাম এতটুকুতে আওয়ামী লীগের সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। নতুন মন্ত্রিসভার পর প্রশাসনের কোথাও পাতাটি নড়ল না। কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। আমলাদেরও আচার-আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে সিইসি আজ থেকে তাঁর আচরণবিধি দিয়ে কী জাদু দেখান, সেটা আমরা দেখব।

বিচারপতি লতিফুর রহমানের ১৩ সচিব বদলি বিএনপিকে বেজায় খুশি করেছিল। ইয়াজউদ্দিনের ১৮ সচিব বদলি আওয়ামী লীগকে সেই ভরসা দেয়নি। আজ থেকে জনপ্রশাসনকে নির্বাচন উপযোগী করার দায় সিইসির। সংবিধান-নির্দিষ্ট ২৭ অক্টোবরকে তাঁরা ধরতে চাননি। আচরণবিধি অনুযায়ী আজ থেকে তা শুরু হলো। তবে এখন ৩৬ সচিব বদলালেও ওই ১৩ সচিব বদলের মতো ধন্বন্তরি হবে না। আদৌ কোনো তাৎপর্যপূর্ণ রদবদলের মুরোদ সিইসি রাখেন কি?

২০০৬ সালের ২ নভেম্বর রোকেয়া আফজাল রহমানের একটি মন্তব্য ছাপা হয় প্রথম আলোতে। প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম, ‘এবার অবস্থা আরও খারাপ: হাজার হাজার বদলি করতে হবে’। এবার সম্ভবত হাজার হাজার শব্দটির স্থানে কেউ লাখ লাখ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইবেন।

২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর প্রথম নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করার সময় এম এ আজিজ ছুটিতে ছিলেন। আজিজ ও তাঁর দল তাঁদের পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ‘সংবিধান রক্ষা’ করার কথা বলে গেছেন। আজিজের পদত্যাগ সম্পর্কে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব বলেছিলেন, সংবিধানে এমন কোনো জায়গা নেই যার আওতায় তিনি তাঁকে সরতে বলতে পারেন।

এক কৃষ্ণ সোমবার থেকে আরেকটি কৃষ্ণ সোমবার। সামনে কৃষ্ণগহ্বর। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদের একটি রায় স্মরণে আসছে। এটি এখনো একটি বলবৎযোগ্য আইন হয়ে টিকে আছে। সংবিধানমতে, ৯০ দিনের মধ্যে যে নির্বাচনের ওপর সিইসি জোর দিলেন, তা ওই আইন সমর্থন করে না। সমঝোতাপূর্ণ অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচনের জন্য ওই রায়ে ৯০ দিনের সীমা পেরোনোর অনুমোদন আছে।