বৈষম্য বাড়ছে যে কারণে

সারা পৃথিবীতেই আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক সেবাপ্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৫ অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ এখন বিশ্বের ৫০ শতাংশ সম্পদের মালিক। আর ৫০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ মাত্র ১ শতাংশ সম্পদের মালিক। সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই সুরে বললেন, দেশে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, এখনো দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র।
কথা হচ্ছে, বিরাজমান ব্যবস্থায় পুরোপুরি বৈষম্য দূর হবে, এটা আশা করা বৃথা। অন্য কোনো ব্যবস্থা তা পুরোপুরি দূর করতে পারে কি না, সে অভিজ্ঞতাও আমাদের নেই। কিন্তু কীভাবে এই বৈষম্য সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়, সেটাই আসল কথা।
এই অসমতার পরিপ্রেক্ষিতেই বড় এক তথ্য ফাঁসের কাণ্ড ঘটল, যাকে বলা হচ্ছে পানামা পেপারস। আমরা জানতে পারলাম, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় ও এমনকি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এই কর ফাঁকির কয়েকটি দিক রয়েছে। একদিকে আছেন তাঁরা, যাঁরা দুই নম্বরি পথে টাকা রোজগার করেন, ফলে সেই টাকার ওপর তাঁদের কর দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়ত, অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বৈধভাবেই এত টাকা আয় করেন যে তার ওপর নির্ধারিত কর দিতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতছাড়া হয়ে যায়, যেটা তাঁরা হতে দিতে চান না। খেলোয়াড় লিওনেল মেসি ও অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এ কাতারে পড়েন। আর তার সঙ্গে আছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা বিশ্বায়নের সুযোগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, কিন্তু ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের (মূল কোম্পানির শাখা কোম্পানিগুলোর মধ্যকার লেনদেন) মাধ্যমে কর ফাঁকি দিচ্ছে। কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে এরাই শ্রেষ্ঠ। সারা পৃথিবীর এই অবৈধ অর্থের গন্তব্য হচ্ছে সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপসহ নানা এলাকা।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২-১৩ করবর্ষে বার্ষিক আয় বিবরণীতে মাত্র ৫ হাজার ৬৬২ ব্যক্তি সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি টাকার ওপর দেখিয়েছেন। এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোটি টাকার ওপর সম্পদ থাকলে করের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মাশুল দিতে হয়। সে কারণে বিত্তশালীরা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকির করেন।
টমাস পিকেটির ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি গ্রন্থে মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ৩০ বছর সম্পর্কে নতুন ভাবনার খোরাক রয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ করের হার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তখন আজকের মতো একটি শ্রেণির হাতে এত সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও আজকের মতো এত বৈষম্য ছিল না। হয়তো সমাজতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তাকে এটা করতে হয়েছে।
কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিঘাত সামলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়। এরপর প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সেটা আরও এগিয়ে নেন। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ, আজকের তীব্র বৈষম্যের বীজ এর মধ্যেই নিহিত। এর মাধ্যমে রিগ্যান প্রথমেই সর্বোচ্চ করের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেন, যাতে ধনীদের হাতে আরও বেশি টাকা জড়ো হয়। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন তিনি। রাষ্ট্র ‘জাতি-রাষ্ট্র’ থেকে ক্রমেই ‘বাজার-রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়, যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে, যার কাজ হয়ে দাঁড়ায় নিরাপত্তা রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাজস্ব ও মুদ্রাব্যবস্থা ঠিক রাখা। আর বাকি সব চলে যায় করপোরেটের হাতে, অর্থাৎ ধনী আরও ধনী হওয়ার সুযোগ পায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকে করপোরেশনের ব্যবস্থাপক ও সিইওদের বেতন আকাশচুম্বী হতে শুরু করে, এ সময় সিইওদের বেতন বাড়ে ৪০০ শতাংশ, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন বাড়ে ৫ শতাংশেরও কম। উল্লেখ্য, এই নব্য উদারনীতিবাদ যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে একই সময়ে শুরু হলেও তারা ক্রমেই উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলে তাদের ওপরও এই মডেল চাপিয়ে দিতে শুরু করে, যারা বাধ্য হয়েই তা কমবেশি গ্রহণ করে।
মানুষের আয় যত বেশি হবে, তার করও তত বেশি দেওয়ার কথা। সে কারণে ধনবান মানুষেরা কর ফাঁকি দেয়। আর দুর্নীতিবাজদের তো কর দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। একই সঙ্গে, রাজস্ব আইন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে তাদের পক্ষে কর ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়। অর্থাৎ একদিকে করপোরেশনের হাতে বিপুল টাকা জড়ো হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে তার মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি দেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে তাঁরা দুদিক থেকেই লাভবান হচ্ছেন। এর মাধ্যমে এক অতি ধনবান শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে।
ধনী মানুষের কর ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমজনতার কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। ভ্যাট নামক পরোক্ষ করের মাধ্যমে ঠিকই তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। আবার আমাদের মতো মধ্যবিত্তের বেতন থেকেই কর কেটে নেওয়া হয় (হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের কর কোম্পানি বহন করে, তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীর বেতন থেকেই তা কেটে নেয়)। এখানে ফাঁকির সুযোগ নেই। অনেক মধ্যবিত্ত সেই ফাঁকি দিতেও চান না। বাংলাদেশ সরকারের সংগৃহীত মোট রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে, অর্থাৎ ভ্যাট থেকে, আর বাকি মাত্র ৩০ শতাংশ আসে প্রত৵ক্ষ কর বা আয়কর থেকে। অথচ এ অনুপাতটা সমান সমান হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে খোদ রাজস্ব বিভাগ। এতে বৈষম্য আরও বাড়ছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় বৈষম্য কমানোর একটি উপায় হচ্ছে ধনীদের আয়ের ওপর আনুক্রমিক হারে করারোপ করা, যে টাকা জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাবদ ব্যয় করতে হবে। উত্তরাধিকার করারোপও করা যেতে পারে। শ্রমিক-কর্মচারী শ্রেণির বেতন বাড়াতে হবে। শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে এবং তঁাদের জীবন টেকসই না হয়, তাহলে কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে না, এই ব্যবস্থাও টেকসই হবে না।
ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ১০ হাজার টাকায় বিফ স্টেক পাওয়া যায়, সেটাও নাকি অনেক লোকে খায়। আবার এই ঢাকা নগরের রিকশাচালককে ফুটপাতে ৩০ টাকায় খেতে হয়। বৈষম্যটা এ পর্যায়ে থাকলে মানবতাই বিপন্ন হয়। আর গণতন্ত্র, তার কথা আর না-ই বললাম।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
[email protected]