এক ক্ষমতাচ্যুত ও ফেরারি প্রেসিডেন্টের কথকতা

লন্ডনের রয়্যাল ওভারসিজ লীগ ক্লাবে বক্তব্য রাখেন মোহাম্মদ নাশিদ
লন্ডনের রয়্যাল ওভারসিজ লীগ ক্লাবে বক্তব্য রাখেন মোহাম্মদ নাশিদ

ছিলেন সাংবাদিক, হলেন মানবাধিকারকর্মী। তারপর রাজনীতিবিদ। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। মাত্র ৪০ বছর বয়সেই বিপুল জনপ্রিয়তায় নির্বাচিত হলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু পতিত স্বৈরাচারের পরিবার ও অনুসারীদের ষড়যন্ত্র আর রাজনীতির কুটচালে অঘোষিত অভ্যুত্থানে হলেন ক্ষমতাচ্যুত। কারাগার, পুলিশি নির্যাতন ও মামলা—তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিকদের কপালে যে প্রায় নিশ্চিত সেগুলোর সবই তাঁর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। একটি নির্বাচনও হয়েছে, তবে প্রথম দফায় প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি ভোট পেলেও দ্বিতীয় দফায় রহস্যজনকভাবে তাঁর ভোট কমেছে। দ্বিতীয় দফা ভোটে তিনি জিতলেও সুপ্রিম কোর্টের কল্যাণে তা বাতিল হয়ে পুনরায় ভোট গ্রহণের মাধ্যমে ৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে তাঁর কপাল পোড়ে। এখন তাঁর দুর্ভোগের পালায় যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ১৩ বছরের কারাদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী এই সাবেক প্রেসিডেন্ট হলেন পর্যটনের স্বর্গরাজ্য মালদ্বীপের মোহাম্মদ নাশিদ। হলিউড ও ইংরেজি সিনেমার সুপরিচিত তারকা জর্জ ক্লুনির স্ত্রী তারকা আইনজীবী আমল ক্লুনি মি নাশিদকে আইনগত সহায়তা দিতে এগিয়ে এলেও সন্ত্রাসের মামলায় তাঁর ওই দণ্ড হয়েছে।
মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনে এবং বিশ্বনেতাদের দেনদরবারের পরিণতিতে মালদ্বীপের বর্তমান শাসক আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম তাঁকে ৩০ দিনের প্যারোলে লন্ডনে আসার অনুমতি দেন। তারপর আরও দুই মাস পার হয়ে গেছে এবং প্যারোল বাড়ানোর আবেদন মঞ্জুর হয়নি। সেই অর্থে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদ এখন একজন ফেরারি আসামি।
কমনওয়েলথ সাংবাদিক সমিতি, সেবামূলক সমিতি রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এবং সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান থমসন ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে লন্ডনের রয়্যাল ওভারসিজ লীগ ক্লাবে মঙ্গলবার রাতে বক্তৃতা দিতে আসেন ওই ফেরারি রাষ্ট্রপতি। বক্তৃতার পর বিভিন্ন প্রশ্নেরও খোলামেলা জবাব দেন তিনি। তাঁর মুখ থেকেই জানা গেল এ পর্যন্ত তিনি জেলে গেছেন অন্তত কুড়িবার। আর সাবালক হওয়ার পরের যে জীবন তার অর্ধেকই (আমার হিসাবে মোট ১৫ বছর) তাঁর কেটেছে জেলে। এখন তিনি কী করবেন? এই প্রশ্নের জবাব খোলাসা না করে বললেন দেশে না ফিরলে আমি ফেরারি, আর ফিরলে ঠিকানা হবে কারাগার—এই উত্তরটি তো সবারই জানা। ব্যক্তিগত আলাপে অবশ্য জানালেন যে চিকিৎসা তাঁর এখনো চলছে।
মোহান্মদ নাশিদের লেখাপড়ার একটা অংশ হয়েছে লন্ডনে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের ধারণা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে মালদ্বীপের একনায়ক মামুন আবদুল গাইয়ুমের কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিতে। শাসকদের নানা ধরনের অন্যায়-অপকর্মের বিবরণ প্রকাশ করতে বের করেন সাময়িক পত্রিকা সাংগু। আর প্রথমবার তাঁর কারাজীবনের অভিজ্ঞতাও হয় সাংবাদিকতার সুবাদে। রাত তিনটার সময় পুলিশ তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মালদ্বীপের সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের ওপর সেই রাষ্ট্রীয় হামলার স্মৃতিচারণ করে মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, তাঁর দেশে সেই নিপীড়নের নীতি আবার ফিরে এসেছে। তিনি এপ্রিলের গোড়ায় ১৮ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার, দেশটির সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া এবং মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার আইন তৈরির কথা বলেন।
সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ১১ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সরকারবিরোধী প্রতিবাদের খবর সংগ্রহের সময় আটক ওই ১৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের সাংবাদিক ছিলেন। এর আগে গত আগস্টে নিখোঁজ হন টিভি সাংবাদিক আহমেদ রিলওয়ান আবদুল্লাহ। ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত রাজি টেলিভিশনে অজ্ঞাতনামা মুখোশধারীরা হামলা চালায়। সিপিজের বর্ণনায় মালদ্বীপ এখন সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি।
মালদ্বীপের রাজনীতিতে অস্থিরতা ঘোলাটে থেকে ঘোলাটেতর হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণও কাজ করছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ নাশিদের পতনের কারণ হচ্ছে গাইয়ুমের অনুসারী ও সুবিধাভোগীরা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন হলেন গাইয়ুমের সৎ ভাই এবং তাঁর মন্ত্রিসভায় গাইয়ুমের এক মেয়েও রয়েছেন। পুলিশ, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও বিচার বিভাগ সব জায়গাতেই গাইয়ুমের কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করা একদল অনুসারী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের সময়েও ক্ষমতায় ছিলেন। ফলে একসময় দেখা গেল পুলিশ ও আদালত প্রেসিডেন্টের আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানালেন। মোহাম্মদ নাশিদ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন বলে সরকারিভাবে বলা হলেও কেউই সে কথা বিশ্বাস করে না। সাবেক প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা–প্রধান নিজেই বলেছেন, তাঁকে বন্দুকের নলের মুখে সরে যেতে হয়েছে। ২০১০ থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর ক্ষমতা হারানোর সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে অভ্যন্তরীণ ওই রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা এতটা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কার্যকর হতে পেরেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিস্পৃহ নিষ্ক্রিয়তা ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণের বাস্তবতায়। ভারত মহাসাগরে প্রভাব সুদৃঢ় করতে চীনের সাধনা ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে ভারতও পিছিয়ে থাকার পাত্র নয়। মালদ্বীপের ওপর তাই তাদের উভয়ের নজর থাকা স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট নাশিদের আমলে অবকাঠামো খাতে চীন বিপুল বিনিয়োগের পথ বেছে নেয়। জল্পনা তৈরি হয় যে চীন তার নৌবাহিনীর কিছু সম্পদ মালদ্বীপে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। আবার মোহাম্মদ নাশিদের ক্ষমতাচ্যুতির পর দায়িত্ব নেওয়া সরকার বৈধ না অবৈধ এই বিতর্কের মধ্যেই ভারতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি মালদ্বীপ সফর করেন এবং সাগরে তাঁদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা (উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) নজরদারিতে সহায়তার প্রস্তাব দেন। দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে চীনের প্রাধান্য বিস্তারের বিপরীতে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ভারতের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে লিখেছেন লন্ডনের কিংস কলেজের ডিফেন্স স্টাডিজের অধ্যাপক এইচ ভি পন্থ (ইন্ডিয়া ডিফেন্স ইটস ব্যাকইয়ার্ড ইন ইন্ডিয়ান ওশান, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২)। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তেলসম্পদের সম্ভাবনা। চীন ও ভারত উভয় দেশই মালদ্বীপের সম্ভাব্য তেলক্ষেত্রগুলোর অনুসন্ধান, উন্নয়ন এবং উত্তোলনের ভাগীদার হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত (ইন্ডিয়া-মালদিভস-চায়না: স্ট্র্যাটেজিক রিলেশনস: আসমা মাসুদ, চেন্নাই সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ)।
লন্ডনে রয়্যাল ওভারসিজ লীগের ভবনটির যে জমকালো মিলনায়তনে নৈশভোজে নাশিদ বক্তৃতা করলেন, সেখানে আমাদের টেবিলটির পেছনে দেয়ালজোড়া একটি ফলক। তাতে লেখা আছে উপনিবেশ যুগে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজন্যবর্গের ডজন খানেক ব্যক্তির নাম—যাঁদের আর্থিক বদান্যতায় ভবনটি নির্মিত হয়েছে। ভারতের শত বছর আগের ক্ষমতাবানদের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েও মালদ্বীপের স্বাধীনচেতা এই নেতা অনেকটা খেদের সঙ্গেই বললেন যে ভারত যদি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে না দাঁড়ায়, তাহলে মালদ্বীপে কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের কোনো আশা নেই। নাশিদ বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন দিল্লি সফর করে গত সোমবার বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে তিনি আশ্বাস পেয়েছেন মালদ্বীপে জরুরি অবস্থা জারির বিষয়ে কমনওয়েলথে আলোচিত হবে না। কমনওয়েলথ জোটের রাষ্ট্রপ্রধানদের গৃহীত হারারে ঘোষণা অনুযায়ী কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষুণ্ন বা স্থগিত হলে তার বিরুদ্ধে জোট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সিএমএজি বা সিম্যাগ নামে পরিচিত কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপের হাতে। ভারতের দ্য হিন্দু ১২ এপ্রিল সংখ্যায় (মালদিভস থ্যাঙ্কস ইন্ডিয়া ফর সাপোর্ট) প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, ‘সিম্যাগে ভারত যে দৃঢ়তার সঙ্গে মালদ্বীপকে সুরক্ষা দিয়েছে, তার জন্য ধন্যবাদ দিতে আমি আজ ভারতে এসেছি। আমি আশা করি, যেকোনো ধরনের অন্যায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে সিম্যাগকে ভারত বিরত রাখবে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় মালদ্বীপের মতো ছোট দেশগুলোকে যেভাবে শায়েস্তা করা হয় তা দুঃখজনক।’ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সিম্যাগ তার সর্বসাম্প্রতিক বৈঠকে মালদ্বীপে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সবার অংশগ্রহণমূলক বা ইনক্লুসিভ করার আহ্বান জানায়।
নাশিদ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, শুধু সামরিক শাসন হলে কমনওয়েলথ ব্যবস্থা নেবে আর আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা হলে নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় থাকবে, এমনটি হলে কমনওয়েলথ ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তিনি কমনওয়েলথে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের আদলে একটি স্বাধীন মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানান, যা মহাসচিবের কাছে জবাবদিহি না করে ৫৩ সদস্যের এই জোটের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ফোরামের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। নাশিদ যখন ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন কমনওয়েলথ সচিবালয়ের ভূমিকা ছিল বিস্ময়করভাবে নির্লিপ্ততার। অবশ্য তখন যে কূটনীতিক সংস্থাটির মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর আমলটি নানা কারণেই সমালোচিত। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মুখে থাকা রাজাপক্ষের হাতে সংস্থার নেতৃত্ব তুলে দিতে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধিতা থাকলেও তৎকালীন মহাসচিব কমলেশ শর্মা তাতে কান দেননি। অবশ্য রাজাপক্ষেকে মি শর্মা তুষ্ট রাখলেও শ্রীলঙ্কার ভোটাররা তাঁকে অল্পদিনের মধ্যেই অবসরে পাঠান। মি নাশিদ তাই যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন যে কমনওয়েলথ কি নিজে শুদ্ধ হবে, বদলাবে? নাকি ক্রমেই তার অপ্রাসঙ্গিকতা বাড়বে?
নৈশভোজের আগে জানতে চেয়েছিলাম রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে তাঁর দেশের ভবিষ্যৎ কী? তিনি সামরিক শাসনের আশঙ্কার কথা বললেন। আর ভোজসভার পর যখন জানতে চাইলাম যে ভারতের প্রকাশ্য সমালোচনা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? তাঁর অভিমত ভারতের নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন মালদ্বীপে স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী গণতন্ত্র।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।