ভূমিকম্প: আমরা কতটা প্রস্তুত?

ইকুয়েডরে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যে ক্ষতি হয়েছে, একই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ক্ষতি হবে অনেক বেশি
ইকুয়েডরে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যে ক্ষতি হয়েছে, একই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ক্ষতি হবে অনেক বেশি

মাঝরাতে মানুষের ঘুম ভাঙে নানা কারণে। কিন্তু আমার জন্য সেদিনের কারণটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ঘুম ভাঙে প্রবল ঝাঁকুনিতে। ঘুম ভেঙে দেখি, বিছানা কাঁপছে। যেন কোনো থিম পার্কের ম্যাজিক কার্পেটে বসে আছি। হতবাক আমি খামচে ধরি তোশকের প্রান্ত। আমার স্ত্রীও উঠে বসেছে। ও-ই বলে, ভূমিকম্প!
সেটা বুঝতে সময় লাগে না। বাসার গৃহকর্মী বুকের মধ্যে আমাদের মেজো মেয়েকে জাপটে ধরে লম্বা করিডর দিয়ে ছুটে আসে। ভয়ে-আতঙ্কে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে সে। তাকে কোনোমতে শান্ত করা হয়। ভূমিকম্প হলে মানুষের মধ্যে দৌড়ে নামার ভূত চাপে। আমরা থাকি ইউনিভার্সিটির বাড়ির চারতলায়। দৌড়ে নামার সময় কি আছে আমাদের!
কম্পন কমলে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াই। বাইরে ধূসর আলো, আকাশে অস্থির কা কা শব্দ, নিচে মানুষের জটলা। কোথাও একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ। দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের প্রায় সব বাসিন্দা নিচে নেমে গেছেন। ওপরেই থাকব না নিচে নামব—এই উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করি।
আমি যে ভূমিকম্পের কথা বললাম তা তিন-চার মাস আগের। এরপর অন্তত আরও দুবার ভূমিকম্প হয়েছে দেশে। শেষবার হলো মাত্র কয়েক দিন আগে। সন্ধ্যার পরপর এই ভূমিকম্পের সময় আমাদের সব সন্তান জেগে আছে। পায়ের নিচটা সামান্য দুলছে দেখে আমি তাদের সাহস দেওয়ার জন্য বলি: ‘আর্থকোয়েক ডান্স করব আমরা এখন।’ এই রসিকতা নিশ্চয়ই পছন্দ হয়নি বিধাতার। হঠাৎ দেখি দুলুনি প্রবল হয়েছে, প্রবল থেকে প্রবলতর। বাচ্চারা চিৎকার করে ওঠে। আমিও তাদের সঙ্গে গলা মিলাই। জোরে জোরে আল্লাহর নাম নিই।
আবারও নিচে মানুষের ভিড়! আমরা নামি প্রায় আধঘণ্টা পর, অন্য একটি কাজে। নিচে তখনো কয়েকটি পরিবার। একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের স্ত্রী আমাদের বললেন: ‘আপনারা নামেননি কেন? টের পাননি?’
আমি বলি: ‘নেমে লাভ কী!’
আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন হোমরাচোমরা অধ্যাপক বললেন: ‘দৌড়ে নেমে আসবেন। পারলে সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নেবেন। সিঁড়ি সেফ!’
সিঁড়ি নাকি সেফ! আমরা দু-এক দিন ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজই হচ্ছে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করা। আরও ভয়াবহ হচ্ছে সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নেওয়া। ভূমিকম্প হলে প্রাণ বাঁচাতে সবচেয়ে জরুরি হলো ড্রপ, কাভার অ্যান্ড হোল্ড মেথড। ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে শক্ত কাঠের টেবিল বা উঁচু খাট বা চৌকির নিচে চলে যেতে হবে। মাথা আড়াল করতে হবে। তারপর টেবিল বা খাটের পা আঁকড়ে ধরতে হবে ভূমিকম্প পুরোপুরি না থামা পর্যন্ত। ঘুম ভেঙে কিছু না পেলে কমপক্ষে বালিশটা রাখতে হবে মাথার ওপর।
প্রশ্ন হচ্ছে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী শিক্ষকেরাই যদি এটা না জানি, অন্যদের কী অবস্থা? আমি ঢাকা ট্রিবিউনে একজন বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার পড়লাম এরপর। ভূমিকম্প হলে নাকি ছুটে ঘর থেকে বের হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে থাকার কথা, আতঙ্কিত হয়ে ছুটে বের হতে গিয়ে দু-তিন মাস আগের ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ ছয়জন মানুষ। তারপরও আমাদের এই ব্যাপক অসচেতনতা কেন? আমাদের ফায়ার সার্ভিস নাকি কয়েক হাজার ভলান্টিয়ারকে ট্রেনিং দিয়েছে ভূমিকম্প হলে মানুষকে সাহায্য করার জন্য। তারা ভলান্টিয়ারদের কী শেখাচ্ছে কে জানে?
সবচেয়ে যা জরুরি প্রশ্ন, ভূমিকম্পের জন্য কতটা প্রস্তুত আছি আমরা? ভূমিকম্প-ঝুঁকি, ভূমিকম্প হলে করণীয়, এর পরের করণীয় সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? ভূমিকম্প সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল, সবচেয়ে ভয়াবহ, সবচেয়ে অপরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জন্য। জনগণের করের টাকায় যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করছেন, তাঁরা কী দায়িত্ব পালন করছেন এ বিষয়ে?

২.
এই কদিনে আমি ভূমিকম্প নিয়ে যতগুলো লেখা পড়েছি তার প্রায় সবগুলোতে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বলা হয়েছে। ঢাকাকে বলা হয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের একটি। এর মধ্যে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন রিসার্চ রয়েছে।
ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি ইনডেক্সে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে একটি। ঢাকার ঝুঁকির কারণ হিসেবে টেকটোনিক প্লেটের লেজের ওপর থাকার কথা, প্রতিবছরে ৩০ মিলিমিটার করে উত্তর-পশ্চিমে সরে যাওয়া, বিভিন্ন সারফেস ফল্ট লাইনের কথাসহ বিভিন্ন কারণ বলা হয়েছে।
সত্তর দশকের পর থেকে বাংলাদেশে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছিল, তা নিম্ন ও নিম্নমধ্য মাত্রার ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতিও ছিল সামান্য। এ কারণে চট করে বড় ভূমিকম্পের এসব আশঙ্কাকে কিছুটা অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, ১৮৮৫ সালে রিখটার স্কেলে প্রায় সাড়ে ৭ মাত্রার যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল বাংলা অঞ্চলে, তার এপিসেন্টার ছিল মানিকগঞ্জে। এ ছাড়া ১৭৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গল বা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে আরও দুটো বড় মাপের ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে বহুল আলোচিত আসাম ভূমিকম্পেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই অঞ্চল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভয়াবহ ভূমিকম্প প্রতি ১৩০-১৩৫ বছরের মধ্যে পুনরায় হওয়ার কথা। সেই হিসাবে ১৮৮৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা বিবেচনা করলে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ঢাকার আশপাশে বিশাল একটি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা মোটেও অবাস্তব নয়। আমরা কতজন জানি তা? কতজনকে জানিয়েছে সরকার?

৩.
বড় ভূমিকম্প হবে কি হবে না, তা এর পরও অনেকটা অনুমানের বিষয়। কিন্তু এটি হলে যে ভয়াবহ ও অমোচনীয় ক্ষতি হবে, সেটিই আমাদের সবচেয়ে জরুরি বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে এমনকি ভারতেও কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে ‘প্রিকশনারি অ্যাপ্রোচ’ গ্রহণ করা হয়। এর মূল কথা হচ্ছে দুর্যোগ হবে—এ ধরনের শক্ত প্রমাণ না থাকলেও ক্ষতির মাত্রা যদি ভয়াবহ ও অপূরণীয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তা এড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আমরা বসে বসে ভূমিকম্প হবে কি না, এ জন্য শক্ত আলামত বা প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু যদি সত্যি এ ধরনের ভূমিকম্প হয়ে যায় তাহলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আর বেঁচেই থাকব না আমরা। ভূমিকম্প হলে যে অকল্পনীয় ক্ষতি হবে তা বিবেচনা করে আমাদের তাই অবিলম্বে ভূমিকম্পের ক্ষতি যথাসাধ্য এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত।
মনে রাখতে হবে, একই মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সব জায়গায় এক রকম হয় না। ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু হবে, তা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিল্ডিং, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর মান, নগরায়ণ কতটুকু পরিকল্পিত, উদ্ধার ও ত্রাণকাজে প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ওপর। এসব বিবেচনায় ঢাকা পৃথিবীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। ৮ স্কেল ভূমিকম্পে তাই জাপানে যে ক্ষতি হয়, ঢাকায় হবে তার শত গুণে বেশি। এমনকি ইকুয়েডরে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যে ক্ষতি হয়েছে একই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ক্ষতি হবে অনেক অনেক বেশি।
আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় বড় ভূমিকম্পের পরিণতির কথা ভাবলে। ঢাকার ঘিঞ্জি অঞ্চল, জলাভূমি ভরাট করে বানানো বিভিন্ন উঁচু বিল্ডিং, নামকাওয়াস্তে ডিজাইন দিয়ে নিম্নমানের ও অপর্যাপ্ত সামগ্রী দিয়ে বানানো বিল্ডিং—এগুলো গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার কথা বড় ভূমিকম্পে। যে ভবন ভূমিকম্প সামলাতে পারবে, তা হেলে পড়বে পাশের ভবনের ধাক্কায়, যে রাস্তা এমনিতে ফেটে যাবে না, তা দুমড়ে–মুচড়ে যাবে দুর্বল উড়ালসড়কের পতনে। যে মানুষ বেঁচে থাকবে, তাকে সাহায্য করতে এগোতে পারবে না অন্য কোনো মানুষ। যে মানুষ ভাঙা বিল্ডিংয়ে যন্ত্রণাকাতর হয়ে আর্তনাদ করবে, তাকে সাহায্য করার উপায় জানবে না পাশের অক্ষত মানুষ। যাদের কোনোভাবে হাসপাতালে নেওয়া যাবে, তারা ধুঁকে মরবে বিনা চিকিৎসায়।
এক রানা প্লাজা কত বড় ট্র্যাজিক স্মৃতি হয়ে আছে আমাদের জীবনে। বড় ভূমিকম্পে এমন রানা প্লাজা ঘটবে ঢাকা এবং আরও বহু শহরের প্রায় প্রতিটি সড়কে, পাড়ায়, গলিতে।
আমার হাইতির ভূমিকম্পের কথা মনে পড়ে। ২০১০ সালের মাত্র ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাইতির কয়েকটি শহরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। হাইতির সেসব শহরের ছবি এখনকার সিরিয়ার সবচেয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের ছবির চেয়েও করুণ। বড় ভূমিকম্পে দুর্নীতি আর কুশাসনে নিপতিত হাইতির মতো দেশগুলোতে মারা যায় সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তিরা টিকে থাকেন প্রবল ভূমিকম্পেও।
আমার ধারণা, আমাদের দেশেও এই শ্রেণিটি জানেন ভূমিকম্পে দেশ ধ্বংসস্তূপ হলেও বেঁচে যাবেন তাঁরা। বেঁচে যাবে তাঁদের পাচার করা বা সুরক্ষিত করে রাখা সম্পদ। না হলে ভূমিকম্পের এত ঘণ্টাধ্বনির পরও কেন তাঁরা নীরব! কেন আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখনো ঘুম হারাম হয়ে যায় না ভূমিকম্প নিয়ে চিন্তাভাবনায়, গোটা জাতিকে প্রস্তুত করায়?
আমরা কি অপেক্ষা করছি ভয়াবহ কোনো গণমৃত্যুর জন্য?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।