ব্যাংকিং সমাচার

প্রাচীনকালে যখন ব্যাংকিং প্রথা প্রচলিত ছিল না, তখন নাকি মানুষ টাকাপয়সা রাখত মোজার ভেতরে কিংবা টাকার থলেতে পুরে মাটির মধ্যে লুকিয়ে। তো মরু অঞ্চলের একজন এভাবে মরুভূমিতে টাকা লুকিয়ে রেখে পরবর্তী সময়ে স্থানটি নির্ধারণ করতে পারছিল না। তাকে যখন বলা হলো তোমার উচিত ছিল কোনো চিহ্ন রাখা, তখন সে বলে উঠল, চিহ্ন তো রেখেছিলাম; আকাশে একখণ্ড মেঘ দেখে ওটার ঠিক নিচে বালুতে টাকাটা পুঁতে রেখেছিলাম।
আর ব্যাংকিংয়ের শুরুটা ইতালিয়ানদের হাতে। তা শুরুতে ওরা নাকি বাজারের মাঝখানে বেঞ্চিতে বসে টাকাপয়সার লেনদেন করত। বেঞ্চের ইতালিয়ান প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘বাংকো’ (Banco), আর এই বাংকো থেকেই ‘ব্যাংক’ শব্দের উৎপত্তি। সে যা হোক। হাসির রাজা মার্ক টোয়েন ব্যাংক তথা ব্যাংকারদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘একজন ব্যাংকার হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি যখন সূর্য আলো ছড়াচ্ছে তখন আপনাকে তাঁর ছাতাটা ধার দেন এবং বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ফেরত চেয়ে বসেন।’
এমনিতেও বলা হয়ে থাকে যে ব্যাংক হচ্ছে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে আপনি ঋণ পেতে পারেন, যদি আপনি এই পরিমাণ আর্থিক সংগতির প্রমাণ দাখিল করতে পারেন যে, তা আপনার ওই ঋণের অনেক অনেক গুণ বেশি। অবশ্য ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংককে বলা যেতে পারে এটার ব্যতিক্রম।
অবশ্য আজকাল আমাদের দেশে বিত্তশালী মানেই ব্যাংকের ঋণখেলাপি। হালের হল-মার্ক এবং হাই-মার্কা কেলেঙ্কারিই এটার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। আশ্চর্যের কিছুই নয় যে একটি বাচ্চা ছেলে যখন বলল ওর বাবা ‘ব্যাংক পরিষ্কার করেন’ তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি ব্যাংকের জেনিটর (পরিচ্ছন্নতাকর্মী), নাকি প্রেসিডেন্ট?’ জেনিটর ব্যাংকের মেঝের ময়লা সাফ করেন আর প্রেসিডেন্ট ভল্টের টাকা সাফ করে দেন।
আমাদের দেশে আজকাল সর্বত্র ব্যাংকের ছড়াছড়িও। তাই তো এক বাচ্চা ছেলে নাকি একবার ওর বাবাকে উদ্দেশ করে বলেছিল, ‘টাকা যদি গাছে না জন্মায়, তাহলে ব্যাংকগুলোর এত্তসব শাখা গজায় কেমন করে!’ আরেক ব্যাংক কর্মচারী কথাচ্ছলে বলছিলেন, ‘আমাদের ব্যাংকে ইদানীং বেশ ঝামেলা হচ্ছে; কেননা দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংকে ডিপোজিটরের চাইতে ভাইস প্রেসিডেন্টের সংখ্যা বেশি।’
যাক গে। ব্যাংক ও ব্যাংকারদের সম্পর্কে অনেক হাস্যরসের গল্প আছে, স্থানাভাব হেতু সব বলা সম্ভব নয়। তবে এ স্থলে দু-একটা না বললেই নয়:
একদা একটি ব্যাংকে ব্যাংকিং আওয়ার্সের পর ক্যাশিয়ার যখন একাকী ক্যাশ বুকে হিসাব মেলানোয় ব্যস্ত, তখন একদল ডাকাত ঢুকে পড়ে পিস্তল দেখিয়ে ক্যাশ নিয়ে কেটে পড়তে উদ্যত হলো। ঠিক তখনই ক্যাশিয়ার তাঁর ক্যাশ বুকটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটাও তাহলে নিয়ে যাও। কারণ, আমার ক্যাশ পাঁচ লাখ টাকা শর্ট।
বিলেতে এক লোক মৃত্যুকালে তাঁর ইংলিশ, ওয়েলস ও স্কট এই তিন বন্ধুর কাছে অনুরোধ রেখেছিলেন তাঁরা যেন প্রত্যেকে তাঁর কফিনে ৫০ পাউন্ড করে রাখেন। তো ইংলিশম্যান ৫০ পাউন্ডের নোট রাখলে পর ওয়েলসম্যানও ওঁর কাছ থেকে ধার করে ৫০ পাউন্ড কফিনে রাখলেন। অতঃপর স্কট্সম্যান ১৫০ পাউন্ডের একটি বিয়ারার চেক কফিনে রেখে ক্যাশ ১০০ পাউন্ড নিয়ে নিলেন। তিন দিন পর তাঁরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে জানতে পারলেন, চেকটি ব্যাংক থেকে ক্যাশ করা হয়ে গেছে। কারণ, কবরস্থানের সংরক্ষক ছিলেন একজন আইরিশ।
তবে ব্যাংক সম্পর্কিত কোনো রস রচনাই নিম্নোক্ত গল্পটির অন্তর্ভুক্তি ব্যতিরেকে পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে না:
এক ব্যক্তি জনৈক ব্যাংক ম্যানেজারকে লোনের জন্য আবেদন জানালে তিনি বললেন, আমার একটি চোখ ন্যাচারাল ও একটি আর্টিফিশিয়াল। আপনি যদি বলতে পারেন কোন চোখটি আর্টিফিশিয়াল, তাহলে আপনি লোন পাবেন, নতুবা নয়। লোকটি ম্যানেজারের চক্ষুদ্বয়ের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার বাঁ চোখটা আর্টিফিশিয়াল।’ ম্যানেজার খুশি হয়ে বললেন, ‘ইউ আর রাইট। আপনি লোন পাচ্ছেন। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি কী করে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারলেন।’ লোকটি তখন একগাল হেসে বললেন, ‘ওই চোখটাই আমার কাছে একটু সিমপ্যাথিটিক (সহানুভূতিশীল) মনে হয়েছে।’
পরিশেষে, সুহৃদ পাঠক! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশের সংরক্ষিত মজুত থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটা ‘কভারআপ’ করতে সরকার যেসব কথা বলছে, তাতে আমাদের গ্রামের সেই গরিব লোকটির উপাখ্যান আমার মনে পড়ে গেছে। তবে পূর্বাহ্ণে জানিয়ে রাখি, আমাদের অঞ্চলে বিড়ালকে ‘বিলাই’ ও তরকারির ঝোলকে ‘শুরুয়া’ বলা হয়ে থাকে—
গরিব লোকটি পুকুর থেকে গোটা কয়েক ছোট মাছ মেরে এনেছেন, স্ত্রী সেটা মাটির পাতিলে পাক করেছেন। দুপুরে দেরিতে একা বসে খাওয়ার সময় দেখা গেল তরকারির বাটিতে কেবল ঝোল, মাছ নেই। স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে স্ত্রী জানালেন, বিড়াল মাটির পাতিল ভেঙে সব মাছ খেয়ে ফেলেছে। স্বামী তখন স্থানীয় ভাষায় কাব্য করে বললেন:
আমারে যে বোঝাও এমনে আর হেমনে; বিলাইয়ে পাতিল ভাঙিয়া মাছ খাইল, তো শুরুয়া থাকল কেমনে?
বলা বাহুল্য, উপাখ্যানটি আমাদের নাসিরউদ্দিন হোজ্জার ‘বিড়ালের ওজন এক কেজি হলে মাংস গেল কোথায় আর মাংসের ওজন এক কেজি হলে বিড়াল গেল কোথায়’ গল্পটি স্মরণ করিয়ে দেয়।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷