ইতিহাসের শিক্ষা

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অবস্থিত আফ্রিকান ইউনিয়নের মূল কার্যালয়ে ৭ ও ৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় রুয়ান্ডা গণহত্যা দিবসের অনুষ্ঠান। ৭ এপ্রিল বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা ও শান্তি প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এ ছাড়া এ দিন শিশু-কিশোরেরা অভিনয় করে ও সংগীত পরিবেশন করে। ৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় গণহত্যাবিরোধী আলোচনা সভা। আফ্রিকান ইউনিয়নে স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত রুয়ান্ডার নারী রাষ্ট্রদূত হোপগাসাতুরার বিশেষ আমন্ত্রণে আমরা উপস্থিত হই আফ্রিকান ইউনিয়নে। আমার স্বামী, যুক্তরাষ্ট্রে শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার অধ্যাপক এবং বর্তমানে আদ্দিস আবাবা ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (আইপিএসএস) সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার, ড. আমর খাইরি আব্দাল্লা বক্তব্য দেন বাকি তিনজন রুয়ান্ডা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। বর্তমানে সে দেশের নতুন রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় জনগণের পরিচয় হুতু বা তুতসি নয়, পরিচয় রুয়ান্ডান হিসেবে। আফ্রিকান ইউনিয়নও রাজধানী কিগালিকে, যেখান থেকে গণহত্যার সূচনা হয়, আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

আমর খাইরি রুয়ান্ডায় প্রথম যান ১৯৯৮ সালে। তখনো দেশটার সর্বত্র গণহত্যার আতঙ্ক ও চিহ্ন বিরাজমান। এরপর আরও কয়েকবার তিনি সেখানে যান। আমর সেখানে জাতিসংঘ মনোনীত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত শান্তিবাদী রাষ্ট্র কোস্টারিকার ইউনিভার্সিটি ফর পিসের (ইউপিস) ডিন এবং ভাইস রেকটর পদে নিযুক্ত থাকাকালীন রুয়ান্ডার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শান্তি ও শিক্ষার প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। তাঁর উদ্যোগে সে সময়, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা ইউপিসের বৃত্তিতে শান্তি ও শিক্ষার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে কোস্টারিকায় এসেছিলেন। এঁরাই ভবিষ্যতের কান্ডারি। এ কারণেই সেদিনের সভায় তরুণ ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

 ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র নেতৃত্ব যখন পরিচালিত হয়, এমন উন্নত চিন্তাধারা থেকে তক্ষুনি সত্যিকারের প্রগতির পথে যাত্রা শুরু হয়। এর বিপরীত চিন্তার প্রতিফলন হলো বৈষম্য, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার নিষ্ঠুরতম সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে স্থায়ী করা। ১৯৭১ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন এবং মৌলবাদী দলগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশেও ভয়াবহ গণহত্যা চালায় এবং এই এপ্রিল মাসেই   প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই সরকার, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের বিজয়কে নিশ্চিত করে। এসব বিষয়েও আয়োজক ও অতিথিদের সঙ্গে আলোচনা হয়।

প্যানেলের প্রথম বক্তা, আফ্রিকান ইউনিয়নের রাজনৈতিক-বিষয়ক পরিচালক ড. খাবেলে মাতলোসা বলেন, যে গণহত্যাকে প্রতিরোধের জন্য কাঠামোগত বৈষম্য দূর এবং এক গোত্র অন্য গোত্রের চেয়ে উত্তম, এই মতবাদকে বদলে জাতীয় একতার নীতি গ্রহণের কথা। কাঠামোগত ও গোত্রভিত্তিক সংঘর্ষে সে দেশের মিডিয়ার অমানবিক ভূমিকার একটি উদাহরণ হলো হুতু-সমর্থিত রেডিও ও টিভি স্টেশন ‘লিব্রে দে মিল কলিন্স’, যা তুতসিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে গণহত্যাকে উসকে দেয়। ড. আমর বলেন, গণহত্যাকে অস্বীকার করার অর্থ হলো গণহত্যাকেই সমর্থন করা এবং অস্বীকারের আড়ালে গণহত্যার নীতিকে জিইয়ে রাখা। গণহত্যা যাতে সংঘটিত না হতে পারে তার জন্য জনসচেতনতার সৃষ্টি, মিডিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা, জাতি-গোত্রভিত্তিক সংঘর্ষ ও গণহত্যাকাণ্ডের পূর্বসংকেতকে পর্যবেক্ষণ, সেই অনুযায়ী অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শান্তি শিক্ষার প্রশিক্ষণকে সমাজের সর্বস্তরে প্রয়োগ করা।

ড. আমর বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানির ইহুদি নিধনের কথা উল্লেখ করেন। আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যের দায়েশ (ইংরেজিতে আইসিস) অনুগত বোকো হারাম সেই সঙ্গে আল-শাবাব, আল-কায়েদা প্রভৃতি সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসলামকে অপব্যবহার করে ত্রাস সৃষ্টি এবং নিরীহ জনগণকে হত্যা করছে। তাদের প্রতিরোধে রুয়ান্ডার হুতু ও তুতসি গোষ্ঠীভুক্ত মুসলিমদের শান্তিবাদী ভূমিকা ভয়াবহতার মধ্যেও আশার একটি বড় দৃষ্টান্ত এবং গবেষণার বিষয় হতে পারে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন। রুয়ান্ডায় গণহত্যা যখন সংঘটিত হচ্ছিল তখন হুতু ও তুতসিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকাগুলো। রুয়ান্ডার মুসলিমরা উভয় গোত্রের অংশ হলেও তারা গণহত্যায় অংশ নেয়নি। বরং তারা হাজা​েরা মানুষের প্রাণ এবং শান্তি রক্ষা করেছিল। এর কারণ হিসেবে তারা জানায় যে ইসলাম ধর্মে জাতিভিত্তিক যুদ্ধ এবং নিরীহ মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ।

অনুষ্ঠানের তৃতীয় বক্তা আফ্রিকা ইউনিয়নে ইথিওপিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ড. তেকাদে আলেমু বলেন, এই গণহত্যার কারণ নির্ণয়ে তাঁর উদ্যোগে যে অনুসন্ধানী কমিটি গঠিত হয়, তার রিপোর্টে এই সত্যই প্রকাশিত হয় যে এই গণহত্যা বন্ধ করা যেত যদি আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব সময়মতো রুখে দাঁড়াত। প্যানেলের শেষ বক্তা, আফ্রিকান ইউনিয়নে নারী, শান্তি এবং নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষ দূত রুয়ান্ডার নাগরিক ড. জন বসকোবুতেরা বলেন, গণহত্যা যখন চলছিল তখন পাশ্চাত্য শুধু উদাসীনতাই দেখায়নি, বরং তাদের অনেকে অবিবেচক লেখা লিখেছেন ও মন্তব্য করেছেন। গণহত্যা চক্রান্তের মূল আসামিরা এখনো বিভিন্ন দেশে পলাতক। গণহত্যার অন্যতম আসামি হুতু ধর্মযাজক সেরম্বা বর্তমানে ফ্রান্সে রয়েছেন এবং তাঁকে তাঁর দেশ রুয়ান্ডায় ফিরিয়ে দিতে আপত্তি জানিয়েছে ফ্রান্স।

অনুষ্ঠান শেষে অনেক তরুণ ছুটে এলেন আমাদের কাছে। তাঁরা শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চান। এক তরুণ রুয়ান্ডার ভাষায় বললেন, ‘কুইবুকা’, মানে স্মরণ করো। সত্যিই, ইতিহাসকে স্মরণ ও রক্ষার মধ্যেই তো নির্মিত হয় আগামীর পথ।

আদ্দিস আবাবা, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬

শারমিন আহমদ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।