কমেছে শিশুমৃত্যুর হার, বেড়েছে শিশুহত্যা

.
.

আইলান কুর্দি আজ বিশ্ববিখ্যাত। বেঁচে থাকলে তার নাম পৃথিবীর মানুষ জানত না। হয়তো সে থাকত পশ্চিমের কোনো দেশের উদ্বাস্তু শিবিরে। সে আজ বিশ্ববিখ্যাত তার নিজের কোনো কৃতিত্বের জন্য নয়, দুর্ভাগ্যের জন্য। তার মতো হতভাগ্য কোটি কোটি শিশুর প্রতিনিধি সে, তাকে বিখ্যাত করেছে আধুনিক প্রযুক্তির মিডিয়া। শুধু যদি কোনো খবরের কাগজের প্রতিবেদনে বলা হতো একটি শরণার্থী শিশুকে সমুদ্রের বালুকাবেলায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে তার কাপড়চোপড় ও জুতামোজা পরা অবস্থায়, তা মানুষের মনে দাগ কাটত না। টিভির পর্দায় তাকে সমুদ্রতটে পড়ে থাকতে দেখে দর্শকের মনটা মুহূর্তের জন্য হলেও কেঁদে উঠেছে। আইলানের বিশ্বপরিচিতি এনে দেওয়ার কৃতিত্ব সেই ফটোসাংবাদিকের, যিনি তার প্রাণহীন দেহ তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেন।
আইলান ঘাতক মানুষের নির্মমতা থেকে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু সে মারা গেছে পানিতে ডুবে। তার আসল আততায়ী মানুষই এবং সেই মানুষ, যারা বিপর্যয় ঘটায় শান্তিপূর্ণ জনপদে, শহরে-বন্দরে। সুতরাং তার হত্যাকারী সমুদ্রের পানি নয়, স্থলের মানুষেরাই। সব মানুষ নয়; সেইসব মানুষ, যারা পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর এবং যাদের হাতে রয়েছে মারাত্মক অস্ত্র। দেশে দেশে প্রতিদিন আইলান কুর্দিরা প্রাণ হারাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নির্মম হাতে।

বরিশাল মহানগর থেকে বানারীপাড়া সদর ৪০ কিলোমিটারের মতো। যখন উপজেলা পৌরসভার উপকণ্ঠে পৌঁছাই, তখন ভরদুপুর। বৈশাখের মধ্যদুপুরে আকাশ থেকে আগুন ঝরছিল। গরমের কারণে লোকজন কোথাও বিশেষ কেউ নেই। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মলিন কাপড় পরা আমার মেয়ের বয়সী একটি মেয়ে। সে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে ভাবলেশহীন। যেন আকাশে কিছু খুঁজছে। হয়তো কারও মুখ। বানারীপাড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রাহাত সুমন বললেন, এর নাম লাবণী, এরই ছেলে মারা গেছে।

পাগল মায়ের মন বুঝতে চায় না যে তার সন্তানকে কেউ আর তার বুকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। গাড়ি থেকে নামতে দেখেই সে ছুটে এল। যেন তার ছেলেকে আমরা তার কাছে ফেরত দিতে নিয়ে এসেছি, পাঁচ দিন সে অন্য কোথাও লুকিয়ে ছিল। সশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। রোদের মধ্যে যে সময়টুকু লাবণীর ভাড়া ঘরটির পাশে ছিলাম, তাকে আমি কোনো কথা জিজ্ঞেস করিনি। দারোগার মতো জেরা করিনি। জানতে চাইনি তার সন্তানের নিহত হওয়ার ঘটনাটির বিবরণ। তা তো জানিই। তার মুখ থেকেও একটি বাক্যও বের হয়নি। সে আমার বুকে মাথা রেখে শুধু কেঁদেইছে। কান্নার সমুচ্চ ধ্বনিতে আমি যা বোঝার তা বুঝে গেছি। অন্যেরাও নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। সাংবাদিকদের বলেছি, লাবণীর ছেলে হাফিজুলসহ সব শিশুর ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সাংসদ আলহাজ মনিরুল ইসলাম।

রিকশাচালক রিপন শেখ ছোট একটি কাঁচা ঘর ভাড়া নিয়ে স্ত্রী লাবণী ও দুই শিশুসন্তানসহ থাকেন সড়কের পাশেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর বাড়িওয়ালি একটি বিউটি পারলারের মালিক। বাংলা নববর্ষের দিন বাড়িওয়ালির দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটছিল রিপন-লাবণীর তিন বছর বয়সী ছেলে হাফিজুলের কান্নায়। বাড়িওয়ালি ক্ষিপ্ত হয়ে এসে লাবণীর ঘরে ঢুকে হাফিজুলকে চৌকির ওপর আছাড় মারেন এবং ঘাড় মটকে দেন। শিশুটি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি ঘটলে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে হাফিজুল পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। হত্যাকারী পালিয়ে যান। রিপন থানায় মামলা করেন। বানারীপাড়া থানার পুলিশকে ধন্যবাদ। তারা খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত হত্যাকারীকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে। হত্যাকারীও একজন মা। তাঁরও রয়েছে দুটি শিশুসন্তান। কিন্তু অন্যের বাচ্চাকে আছড়ে মারায় তাঁর বুক কাঁপেনি। মানুষের নির্যাতনস্পৃহা এত নির্মম।

সাম্প্রতিক সময়ে শিশুহত্যা ও শিশুনির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত সাড়ে তিন মাসে সংবাদপত্রে ৫৫-র বেশি এমন ঘটনার খবর ছাপা হয়েছে। অনেক ঘটনায় শিশুরা নিখোঁজ হয় এবং এক দিন কি দুই-তিন দিন পর তাদের লাশ পাওয়া যায় বাড়ির পাশের কোনো ডোবায়, খালে, বিলে বা নদীতে অথবা ঝোপঝাড়ের মধ্যে, কিংবা ধানখেতে, অথবা পরিত্যক্ত জায়গায় বস্তার মধ্যে। হত্যা করা হয় গলা কেটে, গলা টিপে, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অথবা অন্য কোনো পৈশাচিক উপায়ে। বেশির ভাগই ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত। শুধু একটি ঘটনা ব্যতিক্রম। সরকারি দলের এক জনহিতৈষী সাংসদ তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে হাত পাকা করতে গিয়ে গুলি করেন এক কিশোরকে। পরমায়ু আছে বলে ছেলেটি মারাত্মক জখম হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যায়। জননেতাকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের চেষ্টার কিছুমাত্র ত্রুটি ছিল না, কিন্তু মিডিয়ার লোকজন শত্রুতা করায় তাঁকে অল্পকালের জন্য শ্রীঘর ঘুরে আসতে হয়। এখন অবশ্য তিনি মুক্ত। ধারণা করি, তাঁর আর কোনো ভয় নেই। শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে, সে কথা দিব্যি দিয়ে এ দেশে কেউ বলতে পারে না। ন্যায়বিচার সব ক্ষেত্রে এবং সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

নিহত ব্যক্তির পরিবার জানে, যে চলে গেছে তাকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। সান্ত্বনার জন্য তারা দেখতে চায় হত্যাকারীর উপযুক্ত শাস্তি। ব্রিটিশ প্রবর্তিত বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিলেও তা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। মামলার ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ হওয়ায় গরিবের পক্ষে আইন-আদালত করা, আইনজীবীর চেম্বারে দৌড়ানো সম্ভব হয় না। কেউ যদি সর্বস্ব খুইয়ে অপরাধীর সাজা দেখতে চায়, দীর্ঘ সময় বিচার চলায় তা দেখে যেতে পারে না। একটি ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত হতে পারে শাজনীন হত্যাকাণ্ড। বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় নারী ও শিশু-নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হত্যাকারী এবং মূল ষড়যন্ত্রকারী ও প্ররোচনাদাতা হিসেবে অন্য পাঁচজনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। ২০০৬ সালে হাইকোর্ট পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন। মামলা শুনানির পর্যায়ে আছে।

কিন্তু দরিদ্র রিকশাচালক বাবার পক্ষে হাফিজুলের হত্যা মামলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব, যদি কোনো সংস্থা তাঁর পাশে না দাঁড়ায়। খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত ও পারিবারিক কলহ। সম্পত্তি নিয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে শিশুটির বাবার সঙ্গে রয়েছে বিবাদ। প্রতিশোধ নিতে তাঁর নিষ্পাপ ছেলে বা মেয়েকে খুন করে পুকুরে ফেলে রাখে লাশ। কোনো ঘটনায় বাবা-মায়ের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বলি হতে হয়েছে শিশুকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা-মা নিজেই হত্যাকারী। তাঁদের অপকর্ম দেখে ফেলেছে শিশুটি, মা বা বাবাই গলা টিপে মেরেছে নিজের সন্তানকে। আইনের দৃষ্টিতে হত্যাকারী মা-বাবা কি না তা বিবেচ্য নয়, তার পরিচয় সে খুনি। খুনির সাজাই তার প্রাপ্য।

শুধু শিশুহত্যা নয়, শিশু-নির্যাতন বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একটি নতুন ধরনের বর্বরতা শুরু হয়েছে। গাছের সঙ্গে শিশুকে বেঁধে নির্যাতন।  আমি এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই আমার চোখের সামনে কাগজে দেখতে পাচ্ছি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাশাইল গ্রামে দুই শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করার দৃশ্যের ছবি। কবুতর চুরির অপবাদে তাদের এই মধ্যযুগীয় নির্যাতন। প্রায় প্রতিদিন থাকছে এ জাতীয় ঘটনার খবর।

শিশুহত্যা ও শিশু-নির্যাতনের সঙ্গে সরকারি দল, আধা সরকারি দল এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দলের কোনো সম্পর্ক নেই। দলীয় পরিচয়ের বাইরে সাধারণ মানুষেরাই এ জাতীয় পৈশাচিকতার সঙ্গে যুক্ত। তবে অপরাধ ধরা পড়ার পর তার আত্মরক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। কারও পরিচয় হয় আমি অমুক নেতার সৈনিক, কেউ বলে আমি অমুক চেতনার ধারক। সুতরাং তার গুরুতর অপরাধও লঘু হতে বাধ্য।

বাংলাদেশে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কোটি কোটি, এখানে কত শিশু নির্যাতিত হয় তা অনুমান করা সহজ। গৃহকর্মীদের বিশেষ করে মেয়েশিশুদের ওপর নির্যাতনের খবর কিছু কাগজে আসে, ৯৯ শতাংশই অজানা। নারী-শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের মাত্রা তো সীমাহীন। বিভিন্ন ছোট কারখানায় যেসব শিশু পেটেভাতে কাজ করে, সেখানেই রাতে ঘুমায়, তাদের অনেক ছেলেশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। কিন্তু দুই বেলা শুধু চারটে ভাতের জন্য তাদের সব সইতে হয়।

অপরাধীকে বিচার করে শাস্তি দেওয়ার কাজটি রাষ্ট্রের। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে অপরাধ কমে। কিন্তু সবকিছুর দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপানো যায় না। যে মানুষটি তার সৎছেলে বা সৎমেয়েকে কলা খাওয়ার কথা বলে ঝোপের আড়ালে নিয়ে হত্যা করল, সে ক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে। সমাজকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে নাগরিক সমাজের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। কোনো দেশের নাগরিক সমাজ বলতে শুরু আমাদের মতো মাইক্রোফোনের সামনে বসা জনাকয়েককে বোঝায় না। প্রতিটি জনপদে সচেতন নাগরিকদের, যাঁরা সমাজ ও দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবেন, তাঁরাও নাগরিক সমাজের অংশ। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি এলাকার মুরব্বিরা সন্ধ্যার পরে বসে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত থাকত। থানা-পুলিশের চেয়ে তাঁদের প্রভাব ও ক্ষমতা কম ছিল না। আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর সমাজ চাইলে সরকারের তো ভূমিকা থাকবেই, নাগরিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকারি ও বেসরকারি চেষ্টায় বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ ব্যাপক উন্নতিও করেছে। নারীশিক্ষায় অগ্রগতি গর্ব করার মতো। কিন্তু আজ শিশু-নির্যাতন ও শিশুহত্যার প্রকোপ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যে সমাজে নিষ্পাপ শিশুরা নিরাপদ নয়, সে সমাজে বয়স্করাও নিরাপদ থাকবে না। নাগরিক সমাজের সহযোগিতায় সরকারকে শিশু-নির্যাতন ও শিশুহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, তা না হলে অনেক অর্জন অর্থহীন হয়ে পড়বে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।