জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ও নিরাপত্তা চাই

.
.

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি ক্রমে প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশ্বের প্রায় সব দেশে মে দিবস এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও এই দিবস পালন করছে নিয়মিত। অবশ্য যে দেশে ‘মে দিবসের’ জন্ম, সেই যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবস পালিত হয় না, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় শ্রম দিবস।

কিন্তু এত বছর পরেও আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নেহাত টিকে থাকতেও শুধু আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। এ ছাড়া মজুরিবিহীন শ্রমের অস্তিত্ব আছে, আছে নারীর অস্বীকৃত শ্রম। আইএলও কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও সেই কনভেনশনে স্বীকৃত শ্রমিকদের বহু অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নন, যাঁরা শ্রমিক বলে নিজেদের ভাবেন না—এ রকম পেশাজীবীরাও এখন পরিবারের একাধিক সদস্যের রোজগার ছাড়া জীবন চালাতে পারেন না। কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়। একজনের আয়ে অন্তত চারজনের পরিবার বাঁচার মতো আয় করতে পারবেন সেটাই স্বীকৃত অধিকার।

>মজুরি কীভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে হতে পারে, এই প্রশ্ন খুবই জোরেশোরে তোলা দরকার

বর্তমানে দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। শ্রমিকদের মধ্যে খাতওয়ারি কিছু ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানে তা-ও কার্যকর হয়নি। জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অনুপস্থিতি, চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি থাকা এবং অসংগঠিত খাতের প্রাধান্যের কারণে সব পর্যায়ে মজুরি ও বেতনের ক্ষেত্রে সব সময়ই একটি নিম্নমুখী ঝোঁক বা টান থাকছে। ক্ষুদ্রশিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যেখানে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান করে, সেখানে কোনো মজুরিবিধি নেই, সরকারেরও সে ক্ষেত্রে কোনো দায়-দায়িত্ব বা ভূমিকা দেখা যায় না। দেশে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, যাদের অনেক ক্ষেত্রে কোনো মজুরিই থাকে
না, থাকলেও খুবই কম। আর শিশু শ্রমিকেরাই, আর তাদের মধ্যে মেয়েরা আরও বেশি, সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে। নির্যাতন
ও নিরাপত্তাহীনতার নানা ঘটনার কমই প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে দেশে শিল্পশ্রমিকদের একক বৃহৎ অংশ পোশাকশ্রমিক। অনেক শিল্প উপখাতের শ্রমিকদের অবস্থা পোশাকশ্রমিকদের থেকেও খারাপ। এখানেও ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন তো বটেই, এমনকি বকেয়া মজুরি, ওভারটাইম পরিশোধ, সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার, বেআইনি ছাঁটাইবিরোধী আন্দোলন—এগুলো সব সময়ই চলছে। নির্যাতন, হুমকি, যৌন নিপীড়ন—এসবও নানাভাবে জারি আছে।

সরকারি পরিসংখ্যান এ রকম দাবি করতে চায় যে ৪৫ বছর আগের তুলনায় কৃষি, শিল্পসহ সব পর্যায়ের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বর্ণনামতে, ১৯৬৯-৭০ সালে মজুরি সূচক ১০০ ধরে ২০১৫ সালে নামিক বা টাকার অঙ্কে মজুরি সূচক দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৭, টাকার অঙ্কে বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ। তবে লক্ষ্য করতে হবে যে একই সময়ে চলতি দামস্তরে জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৩০০ গুণ। সরকারি দলিলে দেশের শ্রমিকদের গড় মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৫ হাজার ৫৬২ টাকা। গড় এই মজুরি সঠিক তথ্যের কাছাকাছি হতে পারে, যদি সব শ্রমিকের মজুরি পরিশোধিত হয়, তাঁদের ১২ মাস কাজ থাকে এবং ১২ মাস কাজ করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু বাস্তবতা তার থেকে অনেক দূরে।

পরিসংখ্যানের ধরন থেকে এটা ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে সরকারি প্রতিষ্ঠান মজুরির পরিবর্তন হিসাব করতে গিয়ে আগের প্রান্তের মজুরির কম দিকটা ধরেছে এবং পরের প্রান্তের মজুরির ঊর্ধ্বসীমা ধরেছে। এর ফলে প্রকৃত মজুরির যে বৃদ্ধি দেখা যায়, তা স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের মজুরিচিত্র ছাড়া বাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ নয়। এ ছাড়া সরকারি পরিসংখ্যানে অন্য বড় ঘাটতি হলো কর্মঘণ্টা বিবেচনায় না নেওয়া। একজন মানুষ যদি কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার মজুরি বৃদ্ধি করে, সেই বর্ধিত মজুরিকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি হিসেবে অভিহিত করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

 বিদ্যমান বাজারদর অনুযায়ী হিসাব করলে সরকার নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমায় পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতে চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক আয় হতে হয় কমপক্ষে ১৬ হাজার টাকা। তার মানে, সরকারের হিসাবে প্রাপ্ত গড় মজুরিও দারিদ্র্যসীমার আয়ের শতকরা ৫০ ভাগের নিচে। গার্মেন্টসে সর্বশেষ ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও তাই। মজুরি কীভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে হতে পারে, এই প্রশ্ন খুবই জোরেশোরে তোলা দরকার।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের অবস্থান শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জাতীয় আয়ে তাঁদের অংশীদারত্ব বাড়ল না কমল, সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে অর্থনীতির বিকাশের গতিমুখ চিহ্নিত করা সম্ভব। তিন দশক আগে সইফ উদ দাহার এই অংশীদারত্বের অনুপাত হিসাব করে দেখিয়েছিলেন।

বিশ্লেষণ থেকে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল স্বাধীনতার পর জাতীয় আয়ে শ্রমিক শ্রেণি ও বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের অংশীদারত্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হিসাবটি আমি আরও বিস্তৃতভাবে করেছি। এই অনুসন্ধান স্পষ্ট করে যে স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে দেশের অর্থনীতির বিস্তার ঘটেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়, রোজগারি কাজে যুক্ততা বেড়েছে, লেনদেনের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় সব দিকে। কৃষি, শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে নতুন সম্পদ যোগ হয়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু এই সম্পদ বিস্তারের ওপর অধিকার কেন্দ্রীভূত হয়েছে, বিকাশের ধরনের মধ্য থেকেই উদ্ভূত, একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির হাতে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ, দেশের অর্থনীতি বিস্তারে যাঁরা মূল ভূমিকা পালন করেছেন, এই বর্ধিত সম্পদে তাঁদের অংশীদারত্ব ক্রমাগত কমেছে।

স্বাধীনতার সময়ে এই অংশীদারত্ব ছিল জিডিপির শতকরা ৪০ ভাগ, এখন তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০ ভাগেরও কমে। চার বছর আগেও আমি এই হিসাবে পেয়েছিলাম শতকরা ২৪ ভাগ। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে সর্বজনকথা, মে ২০১৬ সংখ্যায়) অর্থনীতির দৃশ্যমান সমৃদ্ধির পেছনে কৃষিশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকদের কৃতিত্বই বেশি। এর পাশাপাশি আছে নির্মাণ, পরিষেবা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক মানুষ। অথচ এই প্রবৃদ্ধির অংশীদারত্বের অবস্থানের ক্রমাবনতি তাদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তির আপেক্ষিকদুর্বলতার বিষয়টিকেই নির্দেশ করে।

বর্তমানে আইনি-বেআইনি সম্পদ যাদের হাতে কেন্দ্রীভূত, তারা আগের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত ও আগ্রাসী এবং রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনি-বেআইনি সব ক্ষমতাই তারা চর্চা করে থাকে। আর গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী পেশাজীবী নারী-পুরুষসহ বাকি সবাই আগের তুলনায় অনেক বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত ও দিশাহীন। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন অবশ্যই হতে হবে। এর জন্য ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ এবং ‘নিরাপদে কাজের অধিকার’-এর দাবি শ্রমিকসহ সব পর্যায়ের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয়তা তৈরির অভিন্ন ক্ষেত্র হতে পারে।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।