সব প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস কার্যকর হোক

নারীর পক্ষে পুরুষ
নারীর পক্ষে পুরুষ

পারভিন আক্তার আমার প্রতিবেশী। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি এখন সন্তানসম্ভবা। আর পাঁচ মাস পরই তাঁর সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখবে। কিন্তু খুশি হওয়ার বদলে তিনি এখন দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। কেননা, তিনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সেখানে দেওয়া হয় তিন মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি। তা-ও আবার সবেতনে নয়। পারভিন আক্তার ও তাঁর স্বামী দুজনের চাকরির আয় দিয়ে সংসার চলে। সংসারে নতুন অতিথি আসছে। এ সময় যদি মাতৃত্বকালীন ছুটির তিন মাস বেতন না পাওয়া যায়, তাহলে চলবে কী করে। এ নিয়ে পারভিন আক্তারের যত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা।
আসমা খাতুন পাঁচ বছর ধরে কাজ করেন রাজধানীর একটি পোশাক কারখানায়। তিন বছর আগে তাঁর প্রথম সন্তান হয়। এ জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন তিন মাস ২০ দিন। তিনি বলেন, ‘অত ছোড বাইচ্চারে থুইয়া কামে যাওন লাগছে। কী আর করুম। নাইলে তো কামডাই থাকে না।’
পারভিন ও আসমার মতো বহু কর্মজীবী নারী ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন না। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ২০১১ সালে সরকার পূর্ণ বেতনসহ ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান চালু করে। চাকরিজীবনে সর্বোচ্চ দুবার নারীরা এ ছুটি পাবেন। এর আগে ১৯৯৮ সালে মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে বাড়িয়ে চার মাস করা হয়েছিল। মাতৃত্বকালীন ছুটি দুই দফায় বাড়িয়ে ছয় মাস করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠান তাদের নারী কর্মীদের এ ছুটি পুরো ছয় মাস দেয় না। অনেকে দিলেও সবেতনে দেয় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে গিয়ে বা ভোগ করতে গিয়ে চাকরি হারানোর ঘটনাও ঘটেছে। এর একটা দৃষ্টান্ত ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার চরমৌকুরী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামসুন্নাহারের ঘটনা। তিনি ২০১৩ সালে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির কাছে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সেই আবেদনপত্র গ্রহণ করলেও ছুটি মঞ্জুর করেছেন কি না, তা তাঁকে জানাননি। সামসুন্নাহার ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে বিদ্যালয়ে যোগদান করতে গিয়ে দেখেন, তাঁর জায়গায় অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো)
চলতি বছরের গোড়ার দিকে টঙ্গীর মিলগেট এলাকার একটি পোশাক কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে গেলে এক নারী শ্রমিককে নির্যাতন করে বের করে দেওয়া হয়। এ রকম ঘটনা অনেক আছে। সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। তাঁদের সবার ছয় মাস সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত নারীদের ক্ষেত্রে এ সুবিধাপ্রাপ্তির মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা নিয়ম অনুযায়ী ছয় মাসই ছুটি পাচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা পুরো ছয় মাস ছুটি পাচ্ছেন না। তাঁদের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া নির্ভর করে মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে—এই ভয়ে নারীদের নিয়োগই দেয় না। আবার দিলেও দেখে নেয় যে নারীটি ইতিমধ্যে দুই সন্তানের মা হয়ে গেছেন কি না। তবে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নারী কর্মীদের পূর্ণ ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দিচ্ছে। তাদের ধন্যবাদ জানাই।

>ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর পর একজন নারী যখন কর্মস্থলে ফিরে আসেন, তখন তিনি আরও উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ করেন। এতে প্রতিষ্ঠানের যেমন লাভ, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশেরও কল্যাণ

ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়ার ফলে নারীদের যেমন নানা দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়, তেমনি দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের নবজাতকদেরও। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হয় ছয় মাস বয়স পর্যন্ত। এরপর তারা বুকের দুধের পাশাপাশি খেতে শুরু করে অন্যান্য খাবার। কিন্তু ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগে মাকে কর্মস্থলে যেতে হলে শিশুর নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। এটা শিশুকে সারা জীবনের জন্য সমস্যায় ফেলে দেয়। মায়েরা মাতৃত্বকালীন পুরো ছয় মাস ছুটি না পাওয়ায় শিশুকে বুকের দুধের বদলে বিকল্প শিশুখাদ্য খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর। মায়ের দুধের পরিবর্তে অন্য খাবার খেলে শিশু ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, এমনকি ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে, ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হৃদ্রোগ ইত্যাদি হতে পারে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা পুরুষ। তাঁরা নারীদের সন্তানধারণ ও মা হওয়ার কষ্ট সম্ভবত বুঝতে পারেন না। তাই তাঁদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে এত গড়িমসি। তাঁরা কিন্তু দেখছেন না, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হওয়ায় আমরা সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান শিশু পাব। সেই সঙ্গে মায়ের জীবনের ঝুঁকিও কমবে। জন্মের পর শিশুটি মায়ের সান্নিধ্যে থাকায় যত্ন ও ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে এবং মা তাঁর স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে পারবেন।
দেশের স্বার্থেই সব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তাদের উচিত ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা রাখা। কদিন আগে এ বিষয়ে কথা বললাম রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে। ওই স্কুলের শিক্ষিকাসহ অন্য নারী কর্মীদের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় না। ওই অধ্যক্ষ মনে করেন, এভাবে নারীদের ছুটি দিলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, ওই নারী কাজ করছেন না। অথচ বেতন নিচ্ছেন। তাঁর বদলে অন্য কাউকে নিয়োগ দিলে তাঁর কাছ থেকে কাজটা পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের কী? সরকার তো নির্দেশ দিয়েই খালাস। এসব বাস্তবায়ন করতে আমাদের যে কষ্ট হয়, তা তো সরকার বোঝে না।’
ছোট বা মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা-মালিকদের এ অসহায়ত্ব দূর করতে পারে সরকার। অন্যান্য দেশের মতো এ রকম ক্ষেত্রে কর-রেয়াত বা আর্থিক সহায়তা বা ভর্তুকির কথা বিবেচনা করা উচিত। কেননা, নারীকে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলে প্রকারান্তরে দেশেরই লাভ। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর পর একজন নারী যখন কর্মস্থলে ফিরে আসেন, তখন তিনি আরও উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ করেন। এতে প্রতিষ্ঠানের যেমন লাভ, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশেরও কল্যাণ। আর আজকের শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে কর্মজীবী মায়েদের ছুটি দেওয়া অনেক বেশি জরুরি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, আপনারা একটু ভেবে দেখবেন কি?
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।