প্রবৃদ্ধির জোয়ারে রাজনের রাশ ও বাংলাদেশ

রাজন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবে এটি অন্ধ বা কানা মানুষদের যদি আহত করে থাকে, তাহলে সে জন্য। ভারতের প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন নিয়ে তিনি যে মোটেও উদ্বেলিত-উত্তেজিত নন, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ স্পষ্ট করে এ-ও বলেছেন যে দুনিয়াজুড়ে যখন অর্থনীতির মন্দ সময় যাচ্ছে, তখন ভারতের উচ্চহারে প্রবৃদ্ধিকে ‘অন্ধের দেশে কানা রাজা’ বলে তুলনা করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তুলনাটি দেন। এর মানে হলো, প্রতিযোগী ও সমপর্যায়ের তো বটেই, এমনকি উন্নত দেশগুলো যখন অর্থনীতির নিম্ন প্রবৃদ্ধিতে ধুঁকছে, তখন ভারত একা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগলে তা বোকামি। এরপরই সমালোচনার ঝড় উঠলে তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে ব্যাখ্যা দেন, যেখানে তিনি এ-ও বলেন যে অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোর (যা একত্রে ব্রিকস বা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয় সবচেয়ে কম। রাজনের মতে, ‘আমাদের চলতি প্রবৃদ্ধি অবশ্যই সরকারের ও দেশের জনগণের কঠিন পরিশ্রমের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু আগামী ২০ বছর ধরে আমাদের এর পুনরাবৃত্তি করে যেতে হবে, যেন আমরা প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিককে একটি শোভন জীবিকা দিতে পারি। এটা বলার মানে এই নয় যে এ পর্যন্ত যা হয়েছে তাকে খাটো করা হচ্ছে।’

দুই

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এই প্রাথমিক প্রাক্কলন করেছে। এর ফলে আট বছর পর প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করল। এর আগে অবশ্য ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছিল, হয়েছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি—এটা বাংলাদেশের জন্য একটা আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছিল প্রায় এক দশক ধরে। প্রায় সব নীতিনির্ধারক, বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ঘুরেফিরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ‘সর্বরোগের ধন্বন্তরি ওষুধ’ হিসেবে অভিষিক্ত করে ফেলেছিলেন। অবশেষে যখন প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ঘরে উপনীত হলো বা তা অতিক্রম করে গেল, তখন আবার তা নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল।

সরকার, নীতিনির্ধারকসহ অর্থনীতিবিদেরা অনেকেই এটাকে বাংলাদেশের বিরাট অর্জন ও সাফল্য হিসেবে অভিহিত করে উচ্ছ্বসিত-উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এখনো কেউ অরুণ জেটলির কথামতো ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারকে আনুষ্ঠানিক উদ্‌যাপনের উদ্যোগ নেননি। তবে কয়েক বছর আগে ২০১০ সালে যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো এক হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে একটি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।

>বেসরকারি বিনিয়োগের হিস্যা চলতি অর্থবছর জিডিপির ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত অর্থবছর ছিল ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বেসরকারি ভোগ ব্যয়ের অংশও কমেছে। সিংহভাগ বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ার পরও প্রবৃদ্ধির উচ্চহার নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে

অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারকে ৭ শতাংশের নিচেই প্রাক্কলন করেছে। পাশাপাশি অনেক অর্থনীতিবিদ প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার হিসাবটিকে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে করতে পারছেন না একাধিক যৌক্তিক কারণে। যেমন, প্রতিবছর সাধারণত মে মাসে এসে বিবিএস প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক প্রাক্কলনটি প্রকাশ করে। তত দিনে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতির অন্তত নয় মাসের হালনাগাদ চিত্র হাতে চলে আসে। তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী তিন মাসের সম্ভাব্য অবস্থা পূর্বানুমান করে প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয়। কিন্তু এবার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। এর মানে হলো, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সাত মাসের ও কিছু ক্ষেত্রে বড়জোর আট মাসের অগ্রগতির পরিসংখ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে প্রবৃদ্ধির হিসাব কষা হয়েছে।অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনে অনুমান-নির্ভরতা এবার অনেক বেশি হয়েছে। আবার বিবিএসের পরিসংখ্যানেই দেখা যায়, বেসরকারি বিনিয়োগের হিস্যা চলতি অর্থবছর জিডিপির ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত অর্থবছর ছিল ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বেসরকারি ভোগ ব্যয়ের অংশও কমেছে। সিংহভাগ বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ার পরও প্রবৃদ্ধির উচ্চহার নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে। 

তবে এসব হিসাবনিকাশের যৌক্তিকতা-দুর্বলতা বিশ্লেষণের চেয়ে এখন বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বণ্টন কীভাবে হচ্ছে। কী আছে এটা নিয়ে এত উচ্ছ্বাস করার, যেটা রঘুরাম রাজন তাঁর দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। অথচ অর্থনীতির ধারাবাহিক অগ্রগতির ধারায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশজুড়ে মানুষের তো উচ্ছ্বসিত হওয়ারই কথা। কিন্তু এই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বাংলাদেশের রাজধানীতেই লাখ লাখ মানুষ সুষ্ঠু গণপরিবহন-ব্যবস্থার অভাবে নিদারুণ কষ্ট সয়ে প্রতিদিন চলাফেরা করেন। বড় বড় উড়ালসড়কের নির্মাণযজ্ঞে ব্যয় বাড়ে, বাড়ে কিছু বিলাসী গাড়ির চাহিদা ও বিক্রি। আর পরিবহন মালিক-শ্রমিক দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে জিম্মি সারা দেশের কোটি কোটি মানুষ বাড়তি অর্থ ব্যয় করেও পান না নিরাপদ ও শোভন যাতায়াতের সুযোগ। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও স্থাপনে ব্যয় বাড়ে, অথচ শিল্প খাত মানসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় না, দুঃসহ গরমে মানুষ লোডশেডিংয়ে ভোগে। উন্নয়নের বড় নির্মাণযজ্ঞে বড় বড় ব্যয় তো প্রবৃদ্ধিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে ঠিকই, তবে সেই ব্যয়ের মধ্যে কতটা অপব্যয় আর কতটা গুণগত ব্যয়, সেই বিচার-বিশ্লেষণে যাওয়ার কথা ভাবার সময় কি নেই নীতিনির্ধারকদের? দুর্নীতির মাধ্যমে অপচয়-অপব্যয় করে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে সম্পদের স্ফীতি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যকেও যে বাড়িয়ে তুলছে, সেটি নজরে আনতে অনীহা কেন? অথচ এই বৈষম্য সামাজিক অনাচারকেও উসকে দিচ্ছে, ক্ষুণ্ন হচ্ছে ইতিবাচক অর্জনগুলো। সর্বোপরি উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জোয়ারে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে জননিরাপত্তা ও চিন্তা-মতের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) দুদিনের এক চিন্তাশীল আলোচনায় এ বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে গত মাসেই। সেখানেই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রশ্ন তোলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে আমরা কিসের জন্য কী ছাড় দিচ্ছি। আমি যদি নিরাপত্তা ছেড়ে দিই, স্বাধীনতা ছেড়ে দিই, তখন অর্জিত প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি? এই প্রবৃদ্ধি কিসের জন্য?’ (প্রথম আলো পৃষ্ঠা-২০, এপ্রিল ২৫, ২০১৬)। এর মানে এই নয় যে সুলতানা কামাল বা তাঁর প্রশ্নে সহমত পোষণকারীরা প্রবৃদ্ধির বিরোধী। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সুশাসন ও আইনের দায়িত্বপূর্ণ প্রয়োগ ততটাই অপরিহার্য, যতটা অপরিহার্য স্থিতিশীলতা।

তিন

রঘুরাম রাজন প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভারতে বিপাকে পড়েছেন। তিনি বাংলাদেশে থাকলে হয়তো তা বিপদে রূপ নিত।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক  সাংবাদিক