এক মত দুই পথ

গত শুক্রবার দুপুরে খুলনার আভা সেন্টারে ঢোকার মুখেই হোঁচট খেলাম। প্রথম আলোর ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি। আভা সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা। নিচতলায় স্থানীয় রোটারেক্ট ক্লাবের বার্ষিক মিলনমেলা চলছিল। ওরা রোটারি ক্লাবের কিশোর সংগঠন। সেখানে রেড ক্রিসেন্ট, সন্ধানী, কোয়ান্টামসহ আরও অনেক সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের ছোট ছোট স্টল রয়েছে। রক্তদান কর্মসূচিও চলছে। পাশে খাওয়ার ঘরে এক এক দল ঢুকছে। খাওয়া শেষে তারা বেরিয়ে যার যার স্টলে যাচ্ছে। আরেক দল খাওয়ার জন্য যাচ্ছে। এত সুশৃঙ্খলভাবে সব কাজ গুছিয়ে করতে পারে ছেলেমেয়েরা, দেখলে মন ভরে যায়। সারাটা সময় আনন্দ-উৎসবে তারা মেতে রয়েছে।

অথচ আগের চার দিন ছিল বিরোধী দলের অবরোধ। আবার প্রায় সপ্তাহজুড়ে হরতাল-অবরোধের হুমকি ঝুলছে। কিন্তু উৎসবমুখর তরুণ-তরুণীদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার লেশমাত্র নেই। ভবিষ্যতের হাল ধরবে যারা, সেই তরুণসমাজের এই উৎসাহ-উদ্দীপনাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখানেই এগিয়ে চলার শক্তি। প্রথম আলো যে বলছে পথ হারাবে না বাংলাদেশ, তার উৎস এখানেই।


খুলনায় রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা কম। সহিংসতা তেমন দেখা যায়নি। বিগত অবরোধের সময় বিএনপিদলীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বাসার অদূরে একটা ককটেল ফোটানো হয়। এর আগের তিন দিনের হরতালে স্টেশন রোডে অবরোধ করার সময় কিছু ভাঙচুর হয়। এ কারণে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্য সাংসদ, মেয়রদের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানি করা হলে পরিস্থিতি কি শান্ত থাকতে পারে? সে তুলনায় খুলনার পরিস্থিতি শান্তই বলতে হবে। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার ঘটনা নেই। ককটেল ছোড়ার ঘটনাও কম। এ জন্য তাদের ওপর কেন্দ্র থেকে চাপ আসে। বলা হয়, খুলনায় আন্দোলনে তেজ নেই কেন? কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক সমীকরণ একটু আলাদা।

২০০৮ সালের নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের সময়ও খুলনার আসনে নজরুল ইসলাম জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপি নির্বাচন করলে তিনিই হয়তো মনোনয়ন পাবেন। তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমঝোতার সম্ভাবনা কতটুকু আছে বলে তিনি মনে করেন? তিনি বলেন, ‘আমরা তো চাই সবাই মিলে ইলেকশন করি। দেশে শান্তি আসুক। কিন্তু সেটা তো হলো না।’ তাঁর কণ্ঠে হতাশা। অবশ্য তিনি মনে করেন, যদি শেষ মুহূর্তে সমঝোতা হয়, তাহলেও তাঁরা ঠিকই নির্বাচনে দাঁড়াবেন। তাঁরা আন্দোলন ও নির্বাচন—দুটির জন্যই প্রস্তুত।

কিন্তু যদি আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে, তাহলে কী করবেন? তিনি বলেন, এখনো চূড়ান্ত পদক্ষেপের কর্মসূচি তাঁদের জানানো হয়নি। তবে, তিনি মনে করেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার আন্দোলন করবেন। সেই আন্দোলন যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ রাখার চেষ্টা তাঁরা করবেন।

আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর সম্পর্কে নানা অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতায় থাকলে যা হয়। এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ায় এলাকার খারাপ লোকেরা উৎসাহিত হবে বলে তিনি মনে করেন।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে তাঁর দলেরই একজন নেতা হত্যার অভিযোগ ছিল। এই হত্যা মামলাটি বেশ কয়েক বছর মনিটরিং সেলে আটকে রাখা হয়েছিল। হঠাৎ মাস খানেক আগে সেই মামলা চালু করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ওই মামলায় চার্জশিটও হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এ কারণে সবাই ভাবছিলেন, মিজানুর রহমানকে হয়তো আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক হারুনুর রশীদের সঙ্গে আমি টেলিফোনে কথা বলি। তিনি বলেন, ‘রাইট অর রং, পার্টি নমিনেশন দিয়েছে, এর পর আর কথা নেই’। তাঁর কথায় এটা পরিষ্কার যে খুলনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দলাদলি তেমন নেই। এটা তাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট।

বিএনপির নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা সম্পর্কে হারুনুর রশীদ এখনো আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। তিনবার সাংসদ ছিলাম, হুইপ ছিলাম। দুই পক্ষ মাঠে না থাকলে নির্বাচন জমে না।’ তিনি মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে আসত, কিন্তু জামায়াতের জন্য পারছে না। জামায়াত যেহেতু নির্বাচন করতে পারছে না, আর তা ছাড়া তাদের নেতারা যেহেতু একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ছেন, তাই তারা গোলযোগ লাগিয়ে রাখতে চায়। বিএনপিও তাদের ছাড়া রাজনীতিতে জোর পায় না। তাই তারা নির্বাচনে আসতে পারছে না।

এ লেখার সময়, রাত ১০টার দিকে খবর পেলাম, বিএনপি আবারও ৭২ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে। শনিবারকেও এই প্রথম হরতাল-অবরোধের আওতায় আনা হলো। ছুটির দিন হিসেবে অনেকে আজকাল শুক্র-শনিবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখে। বিএনপির অবরোধ সেখানে একটা নতুন সমস্যা যোগ করল। যে অবস্থা চলছে, আন্দোলন ছাড়া বিএনপির আর পথ খোলা নেই। রমনায় বাস পোড়ানো হয়েছে, তার প্ররোচনার দায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ মূল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকার বিএনপিকে তাৎক্ষণিক অবরোধ ডাকতে প্ররোচিত করেছে। ফলে অনিশ্চয়তা নতুন মাত্রা পেল। এ জন্য সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপও অনেকাংশে দায়ী।
কিন্তু দেশবাসী চাইবে, অবরোধের নামে আর একটা বাস-গাড়িতেও যেন পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা না হয়। আর কোনো প্রাণহানি দেখতে মানুষ রাজি নয়।
খুলনা থেকে
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।