হাউ টু রব আ সেন্ট্রাল ব্যাংক

.
.

ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব শহর ফোরটালেজার ব্যস্ততম সড়ক ডম ম্যানুয়েল অ্যাভিনিউ। রাস্তার পাশে নতুন একটা ব্যবসা শুরু করলেন পল সার্জিও। ব্যবসাটি হচ্ছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ঘাসের, বাড়ির সামনে বাগান করার জন্য। দোকানের সামনে প্রতিদিন ঘাস ফেলে রাখা হয়, আর গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্রেতাদের কাছে। সন্দেহ করার মতো তেমন কিছু ছিল না। ব্যবসাটি শুরু হয় ২০০৫ সালের মে মাসের কোনো একদিন।
এর ঠিক তিন মাস পরে, ৬ আগস্ট সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বড় ধরনের চুরি হলো ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকো সেন্ট্রালের ফোরটালেজা শাখায়। প্রায় ১০ জনের মতো চোর ব্যাংকের ভল্টরুমে ঢুকে নির্বিঘ্নে নিয়ে গেল ৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। নোটগুলো ছিল ৫০ রিয়েলের নোট (ব্রাজিলের মুদ্রার নাম রিয়েল)। মোট নেওয়া হয় ১৬ কোটি ৪৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৫০ রিয়েল। সব মিলিয়ে এই নোটের ওজন ছিল প্রায় সাড়ে তিন টন।
চুরি হয় শনিবার রাতে। রোববার ছিল সাপ্তাহিক বন্ধ। ফলে ঘটনাটি ধরা পড়ে ৮ আগস্ট, সোমবার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলার পর। দেখা গেল, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চোরেরা অর্থ নিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে চুরির ঘটনাটি ছিল অভিনব। ঘাসের ব্যবসার আড়ালে তিন মাস ধরে তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে। আর ক্রেতাদের কাছে ঘাস পৌঁছানোর নামে গাড়িভর্তি মাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৮০ মিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চুরি করা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ।
ওই গল্পের শেষ হয়নি এখনো। এখন পর্যন্ত মাত্র ৮০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা গেছে। বাকি অর্থের হদিস পাওয়া যায়নি। জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। আরও তিনজন নিহত হয় অপহরণকারীদের হাতে। অপহরণ করে চুরির অর্থ মুক্তিপণ আদায় করে তারপরই মেরে ফেলা হয়েছিল তিনজনকে। পুরো ঘটনাটাই নাটকীয়, সিনেমার উপাদানে ভরপুর। ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরির ঘটনা নিয়ে সিনেমাও হয়েছিল। ২০১১ সালে ব্রাজিলেই মুক্তি পায় অ্যাসালটো আও ব্যানকো সেন্ট্রাল (সেন্ট্রাল ব্যাংক হেইস্ট) নামের সিনেমাটি।
অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০১৪ সালে কিশোরগঞ্জে ব্রাজিলের মতোই সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা চুরি করা হয়েছিল। জানি না চোরেরা সিনেমাটি দেখেছিল কি না।
ব্রাজিলের ওই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুরির ঘটনা ব্যাংক ডাকাতির ধারণাই পাল্টে দেয়। এর আগে ব্যাংক ডাকাতি মানেই ছিল ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ ঘরানার। অর্থাৎ বন্দুক নিয়ে ডাকাতি, দু-চারটি খুন, তারপর অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। ১৯২৯-এর মহামন্দার সময়ে বিন পার্কার আর ক্লাইড বোরো জুটি ব্যাংক ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের জন্য এখনো ইতিহাসের পাতায় স্থান করে আছেন। ১৯৩৪ সালের ২৩ মে লুইজিয়ানায় পুলিশের ফাঁদে পড়ে দুজনেই নিহত হন। আগ্রহীরা ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়ারেন বেটি ও ফায়া ডানাওয়ে অভিনীত বনি অ্যান্ড ক্লাইড সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন। তুমুল আলোচিত ওই সিনেমার শেষ দৃশ্যটি এখনো সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত মৃত্যুদৃশ্য হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে।
তবে ব্যাংক ডাকাতির কথা বললে আলবার্ট স্পাগগিয়ারির গল্পটি না বললেই নয়। ১৯৭৬ সালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ফ্রান্সের সোসিয়েট জেনারেল ব্যাংক ডাকাতির জন্য তিনি এখনো বিখ্যাত হয়ে আছেন। স্পাগগিয়ারি ও তাঁর সঙ্গীরা অন্তত ছয় কোটি ডলারের সমপরিমাণ ফরাসি মুদ্রা, স্বর্ণ, হিরা চুরি করেছিলেন ব্যাংকের ভল্ট থেকে। এর প্রস্তুতি আর বাস্তবায়নও ছিল অভিনব। স্পাগগিয়ারি প্রথমে একটি বক্স ভাড়া নেন। সেই বক্সে একটি অ্যালার্ম ঘড়ি রাখা ছিল। গভীর রাতে বেজে উঠত সেই ঘড়ি। ব্যাংকের ভল্টে কোনো পাহারা ছিল না, ফলে অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজও কেউ পায়নি। এরপর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু হয়। ভল্টে চুরি করার পর তাঁরা সেখানে বসে খাওয়াদাওয়াও করেন। এরপরই স্পাগগিয়ারি সবচেয়ে আলোচিত কাজটি করেন। ভল্টের দেয়ালে লিখে রাখেন, ‘কোনো অস্ত্র ছাড়া, কোনো সহিংসতা ছাড়া, কোনো ঘৃণা ছাড়াই’।
পুলিশ স্পাগগিয়ারিকে গ্রেপ্তার করলেও তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে থেকে পালিয়ে যান। আর ধরা যায়নি। মনে করা হয়, প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা বদলে ফেলেছিলেন তিনি। এ ঘটনা নিয়েও ফ্রান্সে সিনেমা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবর হচ্ছে, ১৯৮৯ সালে ৫৭ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান স্পাগগিয়ারি।
তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ব্যাংক ডাকাতির এখনকার ধরনটি হচ্ছে ওশেনস ইলেভেন ঘরানার। হলিউডের এই বিখ্যাত ছবিটিতেও দেখা যায়, কোনো সহিংসতা ও রক্তপাত ছাড়াই কীভাবে ক্যাসিনো ডাকাতি করা হয়। যদিও ওশেনস ইলেভেনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরির রেকর্ডটি ব্রাজিল থেকে নিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য এ নিয়ে সিনেমা করার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। গল্পের এখনো অনেকটা বাকি। ঘটনার শেষ জানা হয়নি; বরং রহস্য বাড়ছে।
তবে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে সিনেমা করলে এর নাম হতে পারে ‘হাউ টু রব আ সেন্ট্রাল ব্যাংক’। মার্কিন বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ গত ২০ মার্চ রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে যে সম্পাদকীয়টি লিখেছে, তার শিরোনাম ছিল এটাই। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এর অনেকগুলোর শিরোনামই `হাউ টু রব আ সেন্ট্রাল ব্যাংক’।
বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়। আমাদের রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ সামান্য। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধি পুরোটাই নির্ভর করে প্রবাসী-আয়ের ওপর। হ্যাকারদের নজর এ রকম এক দেশের ওপর পড়ল কেন? ধনী দেশগুলো নানা ধরনের সংকটে আছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে অনেক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের। এসব দেশে পুঁজি আসছে। আয় বাড়ছে। ফলে হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে উঠছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভ বাড়লেও তা রক্ষার নিরাপদ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারেনি এসব দেশ। বিশেষ করে সাইবার সিকিউরিটি। বাংলাদেশে ঘটেছে ঠিক সেটাই। ব্লুমবার্গের এই সম্পাদকীয়তে চুরির জন্য বাংলাদেশকে স্বপ্নের জায়গা (ইট ওয়াজ অ্যা হ্যাকারস ড্রিম) বলেই মন্তব্য করা হয়েছে।
এর বাইরে সম্ভবত হ্যাকারদের আরেকটি অনুমান কাজে দিয়েছে। আর সেটি হচ্ছে তথ্য লুকানোর প্রবণতা। ব্লুমবার্গ বলছে, এটি আমাদের মতো দেশগুলোর একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। হ্যাকারদের ধারণা ছিল যে বাংলাদেশ সহজে রিজার্ভ চুরির তথ্য প্রকাশ করবে না। আর এ সুযোগেই অর্থ পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া সহজ হবে। ঘটেছেও তা-ই। তথ্য জানাজানি হয় ঘটনার এক মাসেরও পরে। এই সময়ের মধ্যেই বেশির ভাগ অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়। সমীকরণটা এ রকম—বাংলাদেশ থেকে অর্থ চুরি করা সহজ, আর ফিলিপাইন থেকে সহজ অর্থ বের করে নেওয়া। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল আর ফিলিপাইনের ক্যাসিনো মানি-লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের বাইরে।
অর্থ চুরির পরে বাংলাদেশ একাধিক তদন্ত শুরু করেছিল। এর মধ্যে সিআইডির তদন্ত এখনো চলছে। ফায়ার আই ও ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছে। আরেকটি প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিটি। এর কোনোটিই সরকার প্রকাশ করেনি। অথচ এগুলো নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রায় সবগুলোতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে নিউইয়র্ক ফেড ও সুইফটও বারবারই নিজেদের দায় এড়িয়েছে, দায়ী করেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। অন্যদিকে আমাদের অর্থমন্ত্রীও একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। এরপর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু অংশ মৌখিকভাবে সাংবাদিকদের জানান। তবে সামগ্রিকভাবে এখানেও দেখা যাচ্ছে তথ্য লুকানোর প্রবণতা। ফিলিপাইন শুনানি করে সব তথ্য প্রকাশ করেছে। অথচ বাংলাদেশে সংসদীয় কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দেখানোই হয়নি। ফিলিপাইন যদি প্রকাশ্য শুনানি করতে পারে, বাংলাদেশ কেন গোপন আলোচনাও করবে না? এভাবে তথ্য লুকানোর প্রবণতায় বাংলাদেশ আদৌ লাভবান হবে না। নিজেদের দুর্বলতা আছে বলেই কি এই প্রবণতা? নাকি সাহসের অভাব?
ব্যাংক ডাকাতির শেষ গল্পটা বলি। একদল ডাকাত গেল ব্যাংক ডাকাতি করতে। অস্ত্রের মুখে এক এক করে সবাইকে বেঁধে ফেলল ডাকাতের দল। ম্যানেজারকে রুমে আটকে রেখে চাবি নিয়ে ফাঁকা করে ফেলল ব্যাংকের ভল্ট। টাকার বস্তা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় কথা বলে উঠল ব্যাংক ম্যানেজার। ডাকাত সরদারকে অনুরোধ করে বলল, ‘দয়া করে হিসাবের খাতাটাও নিয়ে যান। ওখানে অনেক টাকার গরমিল আছে।’
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কথিত হ্যাকাররা অর্থ চুরির পাশাপাশি সব ধরনের লেনদেনের তথ্য মুছে ফেলে প্রিন্টারটাও নষ্ট করে রেখেছিল।

শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
[email protected]