হায় সব 'সামান্য ক্ষতি'!

বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারী থাকে আহত ও স্বজনদের হাহাকারে
বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারী থাকে আহত ও স্বজনদের হাহাকারে

খুব বড় বড় ঘটনা ঘটছে দেশে। রাষ্ট্রক্ষমতা কীভাবে হাতবদল হবে, সেসব নিয়ে কথা, ঘরোয়া থেকে জনপরিসরে, দিন-রাত। বন্ধু-পরিজন-চেনাজানা-দূরের-কাছের—যাঁর সঙ্গেই দেখা হয়, ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়ের আগেই জিজ্ঞেস করেন, ‘বিএনপি কি আসবে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত?’ ‘বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হলেও কত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে আওয়ামী লীগ?’ ‘কত মানুষ যে মারা যাবে! দেশের যে কী হবে!’
মানুষ মারা হবে, এ সত্য মেনেই নেওয়া হয়েছে। দেশের কী হবে জানি না, তাই মুখ শুকনা করে বসে থাকি। ক্ষমতার পালাবদলের লাগাম শুনি এ দেশের মানুষের হাতে নেই আর; বুদ্ধিজীবীরা যেমন বলেন সে কথা, তেমনি বলেন গ্রাম থেকে আসা প্রায় নিরক্ষর কাঠমিস্ত্রি। ক্ষমতার পালাবদলে দেশের মানুষের আর হাত নেই; কথাটি যেমন ক্রমাগত ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজধানী থেকে শহর হয়ে গ্রামের প্রান্তিকতম মানুষটির কাছে, তেমনি বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করতে চাইছে এ দেশের মানুষকে ‘ফেয়ার ইলেকশন’-এর জন্য। যত বেশি আন্তর্জাতিক আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে নির্বাচন, ততই সেটি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। এ এক বর্ণিল গোলমেলে জগৎ, যার আলোকচ্ছটার নিচে পেট্রল বোমায় পুড়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন, আক্ষরিক অর্থে। পুড়ে যাচ্ছে রেললাইন, বাস, দেশের সম্পদ। অনিশ্চয়তায় চার কোটি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। লাখো জেএসসি পরীক্ষার্থীর আতঙ্ক আর ভোগান্তি যে হরতাল বাতিল করতে পারেনি, এক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বাতিল হয়ে গিয়েছিল সেই হরতাল। তাই মনে হয়, যা রটে তার কিছু কিছু কি বটেও! যখনই বলার চেষ্টা করি, তাই বলে হরতালে এত মানুষ মারা যাবে? এত ভোগান্তি হবে? বিদগ্ধ অনেকেই শান্ত গলায় বলেন, গণতন্ত্র অভিমুখীন দেশে ‘ফেয়ার ইলেকশন’-এর মতো বড় ঘটনায় নাকি এমন ছোটখাটো সামান্য ক্ষতি হতেই পারে! উদাহরণ আসে বিশ্বের বড় বড় দেশে কত বছর আগে কী ঘটেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। অকাট্য এসব উদাহরণে অসহায় বোধ করি।

দুই.
বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে ছুড়ে মারা হয়েছিল যে পেট্রল বোমা ২৮ তারিখ সন্ধ্যায়, সেই আগুনে দগ্ধ ১৯ জনের দুজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। রবিন মাতবর (২২) আর তাঁর ফুফাতো ভাই নাহিদ মোড়ল (১৮)। চিকিৎসা নিচ্ছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার, কৃষক রফিকুল ইসলামের ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাহাজুল, সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার আবদুর রাজ্জাক, জজকোর্টের আইনজীবী খোদেজা নাসরীন আক্তার, পুলিশের এএসআই নুরুন্নবীসহ ১৬ জন; জীবন তাঁদের অনিশ্চিত। অনিশ্চয়তায় তাঁদের পরিবারের ভবিষ্যৎ। অথচ কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সবাই। দগ্ধ গাড়ির চালক মাহবুবের স্ত্রীর হাহাকার ‘কে আমাগোরে খাওয়াইব?’
বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারী করে, তবে সেই বাতাসের ঠিকানা ওই কক্ষ পর্যন্তই। একটি ব্যাংকে রান্না করে জীবিকা নির্বাহ করতেন যে আনোয়ারা বেগম; গানপাউডারে উড়ে গেছে তাঁর মগজ, টুকরা হয়েছে তাঁর মাথার খুলি দুই দিন আগে। এ বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত শুধু যানবাহনে দেওয়া আগুন ও পেট্রল হামলায় পুড়েছে ৫৫ জন, মারা গেছে আটজন (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩)। ৮৪ ঘণ্টা লাগাতার হরতালের প্রথম দিনেই লেগুনায় ছুড়ে মারা পেট্রল বোমায় পুড়ে মারা গেছেন মন্টু লাল। মারা গেছে কিশোর মনির। ফেলে রাখা ককটেলকে বল ভেবে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে হাত ঝলসে গেছে শিশু মুরাদের, চোখে জখম হয়েছে রহিমা আক্তারের, কাজের আশায় বসে থাকা দিনমজুর আবদুর রহমানের চোখ গলে গেছে ছুড়ে দেওয়া ককটেলে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায়
মারা গেছে ২৯০ জন, দুই শিশুসহ (দ্য ডেইলি স্টার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩)। বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে দগ্ধ ছাত্র ওহিদুর রহমানের ফুফু হাবিবা আক্তারের বিলাপ ‘এইডা কোন যুগ আইল বাবা?’ তিনি বার্ন ইউনিটে শায়িত সারি সারি দগ্ধ শরীরের তুলনা করেছেন ’৭১ সালের সঙ্গে। থমকে দাঁড়াতেই হয়। আজকের আতঙ্ক কি তবে তুলনীয় হয়ে উঠছে একাত্তরের?

তিন.
মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরের যে চিত্র পাওয়া যায় উপন্যাস, স্মৃতিকথা ও চলচ্চিত্রে, অনেকটা তেমনই কি হয়ে যাচ্ছে হরতাল, বিশেষ করে সাম্প্রতিক অবরোধের দিনগুলো? দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় অল্প কিছু গাড়ি চলে কি চলে না, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ খানিক সময়ের জন্য হয়তো আসেন ক্যাম্পাসে। তবে সবাই সবাইকে সাবধানে থাকার কথা বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান। খবর পাই কোথায় ককটেল ফুটল, কোথায় পেট্রল বোমা। কোনো আন্দোলন নয়, সহিংসতার কাছে নতজানু আমরা। এক অবরোধ শেষে ফের অবরোধের, হরতাল শেষে ফের হরতালের আতঙ্কে মানুষ। ‘নিয়মিত’ এসব খবরের পাশে রয়েছে ‘অনিয়মিত’ ঘটনার আতঙ্ক।
সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজীর বাড়ির পাশের বাড়ি তাঁর। এ ছাড়া দগ্ধ বাড়ির সামনে দিনমজুর শাহজাহানের বাবা, লাঠিতে ভর দেওয়া আবুল খায়ের নিজের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাননি। ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলে আগুন দিল। সব লোক আশপাশের। এখানে বাইরের লোক আসেনি। আমরা চিনি। কিন্তু কীভাবে বলি?’ (প্রথম আলো, ২৪ নভেম্বর, ২০১৩)। এ কথা চেয়ারম্যানের ভাই শহীদুল্লাহর। স্থানীয় জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পর শ দুয়েক লোকের মিছিল নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িসহ ১৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের এ ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বছর দুই ধরে এমন ধরনের হামলার খবর পেতে আমরা অভ্যস্ত, তবে সেসব হামলার বেশির ভাগ সংঘটিত হয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর। বাড়বকুণ্ডের ঘটনা ব্যতিক্রম। এ স্লোগান দিয়েই ১৯৭১ সালেও এমনই অগ্নিসংযোগ করেছিল একই শক্তি। প্রথমে ধর্ম শনাক্ত করে, তারপর ‘মুক্তি’ বেছে, সবশেষে ঢালাওভাবে।
একই স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক দল-নির্বিশেষে কীভাবে শত শত মানুষ হামলা করেছিল বসতবাড়িগুলোয়, সে বর্ণনা দিয়েছেন সাঁথিয়ার বনগ্রামের মানুষ। কুঠার দিয়ে উন্মত্ত জনতা কীভাবে কুপিয়েছিল তাদের টিনের বসতঘর, সেই সাক্ষ্য দাঁড়িয়ে আছে। সাক্ষ্য থেকে গেছে সরকারবাড়িতে তছনছ করে দেওয়া কালীবিগ্রহ আর মণ্ডপ। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দিকে আঙুল উঠেছে সেই সন্ত্রাসীদেরই কাউকে কাউকে নিয়ে এলাকা পরিদর্শনের (৭ নভেম্বর ২০১৩, দ্য ডেইলি স্টার)। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোয় পাঠানো হয়েছে রিলিফের চাল। তাঁরা বলেছেন, তাঁরা ভিক্ষুক নন। ত্রাণ নয়, প্রয়োজন নিরাপত্তার। বাড়ির পরীক্ষার্থী মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছেন দূরে, ফিরিয়ে আনতে সাহস করছেন না। উদ্বেগ তাঁদের, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, নিরাপত্তাহীনতা ততই বাড়বে।

চার.
আতঙ্কের অভয়ারণ্য এখন গোটা দেশ। দিব্যি দেখছি টেলিভিশনের পর্দায়, কারা লাগাচ্ছে আগুন, রেললাইন উপড়ে নিচ্ছে কারা। এসব অপরাধীকে ধরা কি অসম্ভব? সাংবাদিকেরা যদি তাদের ছবি তুলতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন তবে তাদের ধরতে পারে না? জনগণের জীবন ও সম্পদের ওপর নেমে আসা নৃসংশতা প্রতিরোধ না করতে পারার দায় সরকার এড়াতে পারে না। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দলের যেসব নেতা মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমে হাজির হচ্ছেন, সামান্যতম দুঃখ প্রকাশের সৌজন্যটুকুও না দেখিয়ে তাঁরা সরকারকে দায়ী করতে থাকেন সব সহিংসতার জন্য। বাসের দগ্ধ ১৯ জনের ন্যূনতম সুরাহা হওয়ার আগেই ফের ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ঘোষণা দিয়ে দেন। অবরোধের প্রথম দিনেই ‘ঢাকায় ককটেল, চট্টগ্রামে গুলি, রাজশাহীতে ধানের ট্রাকে আগুন’। আর রাত আটটায় মালিবাগের যাত্রীবাহী বাসে ফের ককটেল, নিয়ন্ত্রণ হারানো বাসে নিহত হাবিবুর রহমান নামের একজন।
সময় কি লিখে রাখে রাজনীতির নামে এসব ‘সামান্য ক্ষতি’র খতিয়ান!
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।