সিদ্ধান্ত, কাজ ও স্মৃতির ধারক আর্কাইভস

২০১১ সালের ১০ নভেম্বর ইউনেসকো আর্কাইভস বিষয়ে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদিন ইউনেসকোর পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সভায় ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) প্রস্তাবিত ‘আর্কাইভস বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণা’ বা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অন আর্কাইভস’ সংক্ষেপে ‘ইউডিএ’ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই যুগান্তকারী ঘোষণা আর্কাইভস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া এটি নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও আর্কাইভস বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির অধিকতর সুযোগ এনে দেবে।
ঘোষণাটি সংক্ষিপ্ত হলেও এতে যথেষ্ট জোরালোভাবে সমাজ গঠনে আর্কাইভসের ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে। ঘোষণায় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ক্ষেত্রে আর্কাইভসের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে; একই সঙ্গে এখানে নাগরিকের তথ্য অধিকারকে সুলভ করেছে, যাতে যুগোপযোগী সরকারি ও বেসরকারি প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পাশাপাশি সমাজের সমষ্টিগত স্মৃতি সংরক্ষণকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং ইতিহাস অনুসন্ধানে বা গবেষণায় আর্কাইভসের প্রচলিত বা প্রথাগত প্রয়োজন অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
২০০৭ সালে কানাডার কিউবেক শহরে আর্কিভিস্টরা এই ঘোষণার প্রথম খসড়া তৈরি করেন। আইসিএর অঙ্গসংগঠন ‘সেকশন ফর প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ)’ আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিং গ্রুপের সহযোগিতায় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্প্রদায়গুলোর ভাষা, সংস্কৃতি এবং আর্কাইভস ঐতিহ্যের ভিন্নতা বিবেচনা করে খসড়াটির নতুন সংস্করণ তৈরি করে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত আইসিএর বার্ষিক সাধারণ সভায় এটি গৃহীত হওয়ার আগে সদস্যদের মধ্যে এ বিষয়ে অনেক প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। আইসিএর চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এটি অনলাইনে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয় এবং স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। বাংলাদেশ থেকেও কেউ কেউ এই প্রচারাভিযানে যোগ দেন।
এরপর থেকে আর্কাইভস-সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঘোষণাটি ইউনেসকো কর্তৃক গৃহীত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর ইউনেসকো ‘আর্কাইভস বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণা’টি অনুমোদন করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণার আর্টিক্যাল ১৯-এর সঙ্গে সংগতি রেখে এই ঘোষণাটি প্রণীত হয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এ উল্লেখ আছে যে প্রত্যেকেরই তথ্য ও মতামত অন্বেষণ ও প্রচার করার অধিকার আছে। এ ছাড়া প্রণীত ঘোষণাটি ইউনেসকো সংবিধানের আর্টিক্যাল ১, যেখানে উল্লেখ আছে যে সদস্যদেশগুলো জ্ঞান সংরক্ষণ, প্রসার আর প্রচার করবে, এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ঘোষণার দ্বারা ইউনেসকো স্বীকৃতি দিয়েছে যে আর্কাইভস নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
ইউডিএর লক্ষ্য হচ্ছে—ক. আর্কাইভস ও আর্কিভিস্টদের প্রয়োজনীয়তা, তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা ও সমঝোতা নিশ্চিত করা; খ. মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আর্কাইভসের ভূমিকাকে প্রচার করা; গ. আর্কাইভসের অনন্যতার কারণে এটি প্রশিক্ষিত আর্কিভিস্ট দ্বারা পরিচালনার প্রয়োজন তুলে ধরা; ঘ. আর্কাইভসের ব্যবহার বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা এবং ঙ. সরকার, নীতিনির্ধারক ও জনসাধারণকে আর্কাইভস-সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে সম্পৃক্ত করা।
ঘোষণার ভূমিকায় উল্লেখ আছে, ‘আর্কাইভস সিদ্ধান্ত, কাজ ও স্মৃতিকে ধারণ করে। আর্কাইভস একটি অনন্য ও অপ্রতিকল্পনীয় ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহমান থাকে। আর্কাইভস তার মূল্যবোধ ও মান সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আর্কাইভস তথ্যের বিশ্বাসযোগ্য উৎস, যা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ভিত্তি নির্মাণ করে। এটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্মৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। আর্কাইভসে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রাখার মাধ্যমে মানবসমাজ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে, গণতন্ত্রকে সচল রাখে, নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা করে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে।’
ঘোষণায় আর্কাইভসের অনন্য বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য ও আবশ্যকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে নথি সৃষ্টির বহুমাত্রিকতা, প্রশিক্ষিত আর্কিভিস্টদের ভূমিকাকে; সর্বোপরি আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারকসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সম্পৃক্ততাকে।
যেখানেই নথি সৃষ্টি হচ্ছে বা যেখানেই নথি স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেখানেই ঘোষণাটি কার্যকর করা যেতে পারে। এ ছাড়া নথি ও আর্কাইভস-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা এই ঘোষণার আওতায় তাঁদের কাজের মান ও পরিধিতে উন্নতি সাধন করতে পারেন।
ঘোষণাটি বাস্তবায়নে প্রথমেই আমাদের আর্কাইভস সম্পর্কে গতানুগতিক ও বাতিল হয়ে যাওয়া ধারণাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এটি একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা বাধা, যা অতিক্রম করে আর্কাইভসকে সমাজের স্মৃতির আধারে পরিণত করতে হবে। এর পাশাপাশি আর্কাইভসকে দেশ ও জাতি পরিচালনায় যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।
ইউনেসকোর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এই ঘোষণায় সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয় আর্কাইভস এ বিষয়ে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন; ফলে ঘোষণাটির প্রচার, অগ্রসাধন ও প্রয়োগে জাতীয় আর্কাইভসকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। নথি ও আর্কাইভস-সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও ব্যক্তির পাশাপাশি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ পৌঁছে দিতে হবে। ঘোষণাটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং এটি অনুসরণের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
নথি ও আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় আমাদের বিশেষ কোনো সুনাম নেই; বরং জাতীয় আর্কাইভস, বিভিন্ন নথি সংরক্ষণাগার ইত্যাদির দিকে নজর দিলে দৈন্যের ছাপ ফুটে ওঠে। তাই এই সর্বজনীন ঘোষণার সাহায্য নিয়ে আমরা দেশের সার্বিক নথি ও আর্কাইভস ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধনের প্রচেষ্টা নিতে পারি।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।
[email protected]