সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়বে, কেন ছাড়বে?

ঝিনাইদহে নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর স্ত্রী শেফালী গাঙ্গুলীর আহাজারি
ঝিনাইদহে নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর স্ত্রী শেফালী গাঙ্গুলীর আহাজারি

‘তোমরা হিন্দু। বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র। এ দেশে ধর্ম প্রচার করতে পারবে না। তোমরা ভারতে যাও। না হলে তোমাদের কুপিয়ে হত্যা করা হবে।’
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান পুরোহিতের কাছে লেখা এই কথিত চিঠিটি পাঠিয়েছেন জনৈক আবু বক্কর সিদ্দিক। ঠিকানা লেখা হয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট অব বাংলাদেশ, চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাঁও মার্কেট, গাজীপুর মহানগর’।
ইসলামিক স্টেট অব বাংলাদেশ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। চিঠির ঠিকানা ও প্রেরকের নামও বানোয়াট হতে পারে। কিন্তু চিঠিতে দেওয়া হুমকিটা মিথ্যা নয়। আর এই হুমকি এমন সময়ে এল, যখন দেশব্যাপী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলছে। জঙ্গিদের কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। কিন্তু তারপরও হত্যার হুমকি থেমে নেই।
সরকারের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হত্যার শিকার হলেন পাবনায় অনুকূল ঠাকুর আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে। গত বুধবার জঙ্গিরা কুপিয়ে আহত করল মাদারীপুরের কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে। অন্যান্য ঘটনায় হামলাকারীরা ধরা না পড়লেও এখানে স্থানীয় জনগণ হামলাকারী একজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। নাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম। ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা ফয়জুল্লাহ একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় জঙ্গিদের সংস্পর্শে আসেন। এ রকম বহু ফয়জুল্লাহকে জঙ্গিরা দলে ভিড়িয়েছে। তাদের অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে রাজীব হায়দার হত্যার আসামিরাও ছিল একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভয়টা এখানেই। আগে জঙ্গিদের টার্গেট ছিলেন ব্লগার ও ভিন্ন চিন্তার মানুষ। এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরই হামলার ঘটনা ঘটছে বেশি।

উড়ো চিঠির হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ রামকৃষ্ণ মিশনের নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। সেটি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হলো দেশে এমন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ তৈরি, যাতে জঙ্গি বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী কাউকে হুমকি দিতে বা কারও ওপর হামলা চালানোর সাহস দেখাতে না পারে।

.

দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতার খবরের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে বিতর্কও বাড়ছে। ক্ষমতাসীনেরা দাবি করছে, সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা একমাত্র তারাই দিতে পারে। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এই সরকারের আমলে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু কেউ নিরাপদ নয়। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, তাঁরা রাজনৈতিক খেলার শিকার হতে চান না, জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা চান।

পরিসংখ্যান বলছে, পাকিস্তান আমল তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও অধিকাংশ সময় সংখ্যালঘুদের কাটাতে হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। তঁাদের দাবি পঁচাত্তরের পর থেকে তঁারা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে দাঙ্গা লাগিয়ে সংখ্যালঘুদের বহু ঘরবাড়ি ও মন্দির ভাঙা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে। তখন পূর্ণিমা-সীমাদের কান্নায় বাতাস ভারী হলেও অপরাধীরা শাস্তি পায়নি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুরা ভেবেছিল পরিস্থিতির উন্নতি হবে। হ্যাঁ, উপরিকাঠামোয় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তৃণমূলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও বাড়ি দখল-জমি দখলের ঘটনা বন্ধ হয়নি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০১৫ সালেই সংখ্যালঘুদের ওপর ২৬২টি হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে ২৪ জন নিহত ও ২৩৯ জন আহত হয়। এ ছাড়া ২৪ জন নারী অপহরণ ও ২৫ জন ধর্ষণের শিকার হন। চলতি বছর গত পাঁচ মাসে নিহত হন ১০ জন, ধর্ষিত হন ৮ জন নারী, হত্যার চেষ্টা হয়েছে ৬টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর নির্বাচনে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলার মালোপাড়ার সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করা হয়। দিনাজপুর সদরের কর্ণাই, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানেও তাদের ওপর হামলা চালায় নির্বাচনবিরোধীরা। ২০১৩ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর সারা দেশে জামায়াত-শিবির যে তাণ্ডব চালায়, তারও অন্যতম টার্গেট ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন ও উচ্ছেদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দল একযোগে কাজ করে থাকে। ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা কিংবা ২০১৫ সালে বরগুনায় সংখ্যালঘু উচ্ছেদের ঘটনা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

.

দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সেই অনুপাতে বাড়ছে না। ২০০১ ও ২০১১ সালের শুমারির জেলাভিত্তিক তথ্য পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়, ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে। জনসংখ্যাবিদদের মতে, এটি ‘মিসিং পপুলেশন’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’। বরিশাল বিভাগের কোনো জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যা বাড়েনি। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা—এই ছয়টি জেলায় ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা—পাশাপাশি এই তিন জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। বিভাগের নড়াইল ও কুষ্টিয়া জেলার প্রবণতা একই। ঢাকা বিভাগের মধ্যে এ তালিকায় আছে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলায়ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে হিন্দু বাড়েনি। (প্রথম আলো ২০১২-এর ২২ সেপ্টেম্বর)। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বরিশালে ও খুলনা বিভাগেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা কমার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে আমাদের আরও পেছনে তাকাতে হবে। ১৯৪৭ সালে দেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৭৬ দশমিক ৯ ভাগ আর হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ ভাগ। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা দঁাড়ায় যথাক্রমে ৮০ দশমিক ৪ ভাগ ও ১৮ দশমিক ৫ ভাগ। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মুসলিম ছিল ৮৫ দশমিক ৪ ভাগ ও হিন্দু ছিল ১৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা হয় যথাক্রমে ৮৬ দশমিক ৭ ভাগ ও ১২ দশমিক ১ ভাগ; ১৯৯১ সালে ৮৮ দশমিক ৩ ভাগ ও ১০ দশমিক ৫ ভাগে;  ২০০১ সালে ৮৯ দশমিক ৭ ভাগ ও ৯ দশমিক ২ ভাগে। আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মুসলিম ৯০ দশমিক ৪ ভাগ, হিন্দু ৮ দশমিক ৫ ভাগ, বৌদ্ধ শূন্য দশমিক ৬ ভাগ, খ্রিষ্টান শূন্য দশমিক ৩ ভাগ ও অন্যান্য শূন্য দশমিক ২ ভাগ।

সংখ্যালঘুদের ওপর  হুমকি-ধামকি কিংবা অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকলে বাংলাদেশে তাদের সংখ্যানুপাতটি ঠিক থাকবে তো?

.

পৃথিবীর সব দেশেই যেকোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্যোগে সংখ্যালঘুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। ৪৫ বছর বয়সী বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আর এ কথাও সত্য নয় বাংলাদেশের মুসলমানেরাই শুধু পাকিস্তান এনেছিল। পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পাশাপাশি নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা প্রতারিত হয়েছে। তফসিল সম্প্রদায়ের নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যোগেন মণ্ডলকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সেটি ছিল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান আমল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে কেন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায় একসঙ্গে থাকতে পারবে না? 

আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করছি। অথচ সভ্যতার প্রধান ভিত্তিই হলো অন্যের ওপর জবরদস্তি না খাটানো। কারও সম্পত্তি দখল না করা। আমরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করছি, অথচ যেখানে সুবিধা আমরা বাঙালি হয়ে যাচ্ছি, যেখানে সুবিধা ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখছি।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার আদয়ের আন্দোলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের একটি জোরালো ভূমিকা আছে। রানা দাশগুপ্ত সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি আরও উচ্চকণ্ঠ। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি। রানা দাশগুপ্ত কেবল সংখ্যালঘুদের সমস্যার কথা বলছেন না, দেশ শাসনেও তাদের ন্যায্য হিস্যা চাইছেন। ফলে ক্ষমতার ভেতরের ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।  

অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে গাল দেন। কিন্তু তাঁরা রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবি করেন না। সংখ্যালঘুদের সেক্যুলার হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার আগে সংবিধান ও রাষ্ট্রকে সেক্যুলার করা যে জরুরি তা তাঁরা ভুলে যান। ভারতে মুসলিম লীগের ভূমিকা ও পাকিস্তানে মুসলিম লীগের ভূমিকা এক নয়। ভারতে তারা নিজ সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে (কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টিও অতীতে তাদের সঙ্গে জোট করেছে)। আর পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করেছে। বাংলাদেশেও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে মুসলমানদের হটিয়ে দেওয়ার আন্দোলন করছে না। তারা আন্দোলন করছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ।

বাংলাদেশে হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে বা তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে কী বাংলাদেশ লাভবান হতে পারবে? পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দেশটিতে যেমন সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলছে, একইভাবে সংখ্যাগুরুরা নিজেরা মারামারি করছে। সেখানে শিয়ারা সুন্নিদের মারছে, সুন্নিরা শিয়াদের মারছে। আর সবাই মিলে হত্যা করছে মানবতাকে। বাংলাদেশেও যাতে সেই পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য এখনই আমাদের সজাগ হওয়া উচিত। সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো উচিত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ নয়, সংখ্যাগুরুদের স্বার্থেও। বহুত্ববাদের ধারণা থেকে রাষ্ট্র একবার সরে এলে সেটি ফিরিয়ে আনা কঠিন।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা মাটি কামড়েই দেশে থাকতে চায়। তারা ভারত বা অন্য কোনো দেশে যেতে চায় না। সেই কথাটিই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নেতারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বোঝাতে চাইছেন। কিন্তু তঁারা সেটি অনুধাবন করতে পারছেন কি?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক