তানজিলার জন্য কষ্ট

তানজিলার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। মাত্র সাত বছর বয়স হয়েছিল মেয়েটির। এই অল্প বয়সেই পৃথিবীর মানুষের নিষ্ঠুর রূপটি তার দেখা হয়ে গেল! এতটুকু একটি মেয়ে। মাত্র প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। আর এই এতটুকু মেয়েটিকে কিনা পুরুষের লালসার শিকার হতে হলো! শুধু তা-ই নয়, নিষ্ঠুর উপায়ে তার প্রাণটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

শনিবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় তানজিলার মর্মান্তিক এই পরিণতির খবরটি ছাপা হয়। তানজিলা রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার দুরামিথিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার বাবা একজন কৃষক। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তানজিলা ছিল সবার ছোট। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে তানজিলার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না।

শুক্রবার দুপুরে পীরগঞ্জ থানার পুলিশ রামনাথপুর ইউনিয়নের প্রধানপাড়া গ্রামের আবদুল মোমিনের বাড়ি থেকে ওই লাশ উদ্ধার করে। আবদুল মোমিনের ছেলে রিয়াদ (১৮) শিশু তানজিলাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখেন। পুলিশ রিয়াদকে আটক করেছে। রিয়াদ পুলিশের কাছে জানিয়েছেন, শিশুটি ঘটনা ফাঁস করে দিতে পারে—এই ভয়ে রিয়াদ তার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন। আহা! কী করুণ মৃত্যুই না হলো তানজিলার।

তবে বাংলাদেশে তানজিলাই প্রথম শিশু নয় যাকে কিনা এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। অতীতে অনেক মেয়েশিশুই এমন ঘটনার শিকার হয়েছে। গত মে মাসেরই ঘটনা। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিবনাথপুর গ্রামে রিতু খাতুন নামে একটি শিশুকে ধর্ষণ করার পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। রিতুর বয়সও সাত বছর ছিল। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দক্ষিণখান এলাকায় সাদিয়া আফরিন নামে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। প্রতিবেশীর বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে হাত, পা ও গলায় রশি বাঁধা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি জুন মাসে বাগেরহাটের চিতলমারীতে জাকিয়া সুলতানা নামে ১১ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ রকম ঘটনার কথা লিখে শেষ করা যাবে না।

ধর্ষণ সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি এই শব্দটি যারা শোনেওনি সেই শিশুরাই কিনা প্রায়ই এই জঘন্য ঘটনাটির মুখোমুখি হচ্ছে। আর দিন দিন শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শিশু অধিকার ফোরাম গত বছরের নভেম্বর মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬২টি আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ঘটেছে ২৩০টি অর্থাৎ প্রায় চার গুণ। এমনকি ২০১৪ সালের পুরো ১২ মাসে যেখানে ১৯৯টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ঘটেছে ২৩০টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা।

ধর্ষকের তালিকায় কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও রয়েছেন। কোন প্রবৃত্তি, কোন বিকৃত মানসিকতা তাদের শিশু ধর্ষণে উৎসাহিত করে? তারা শিশু বলেই কি? শিশুদের তো বাধা দেওয়ার শক্তি নেই। তাদের সঙ্গে যা খুশি করা যায়। তাই ধর্ষণও করা যায়।

আর বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে এমন ভয়ংকর একটি অপরাধের শাস্তির বিষয়টি বাংলাদেশে তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ আইনের (সংশোধনী ২০০৩) ৯ (১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। এই আইনের ৯ (২) ধারায় ধর্ষণের কারণে ধর্ষিতার মৃত্যু হলে ধর্ষকের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকার অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ৯ (৩) ধারায় গণধর্ষণের শাস্তি প্রত্যেক ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকার অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।


তবে আমাদের দেশে ধর্ষণের ফলে ধর্ষিতার অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও কোনো ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এমনটি আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। বড়জোর কয়েক বছরের জেল ও জরিমানা। এই হচ্ছে শাস্তি! বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশে অন্যান্য অপরাধের মতো শিশুধর্ষণকেও উৎসাহিত করছে। জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনায়াসে জামিন পাচ্ছে ধর্ষকেরা। তাহলে ধর্ষণ বন্ধ হবে কীভাবে?

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক