অরল্যান্ডো: বালুতে ডোবানো মাথা

নাইট ক্লাবে নিহতদের জন্য শোক
নাইট ক্লাবে নিহতদের জন্য শোক

পেসেন্স কার্টারের বয়স মাত্র ২০ বছর। দুই বন্ধুর সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভ্যাকেশন কাটাতে অরল্যান্ডো গিয়েছিল। ওই শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাইট ক্লাবের নাম ‘পালস’। সেখানেই শনিবার রাতে ঘটল সেই নারকীয় কাণ্ড। ২৯ বছর বয়সের এক যুবক ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করল ৪৯ জনকে, জখম করল আরও ৫৫ জনকে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আছে কার্টারের এক বন্ধু। সে নিজে জানে বেঁচে গেছে, যদিও তার দুই পায়েই গুলি লেগেছে। এখন কার্টারকে এই গ্লানি নিয়ে বাঁচতে হবে যে সে বেঁচে আছে, তার বন্ধুটি মৃত।
নিজের বেদনার কথা প্রকাশ করার জন্য কার্টার কবিতার আশ্রয় নিয়েছে। সে লিখেছে, ‘বেঁচে থাকার গ্লানি এত ভারী, মনে হয় বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের ঢেউ প্রবল বেগে এসে আঘাত করছে।’ ফ্লোরিডা হাসপাতালের শয্যা থেকে অসুস্থ অবস্থায় কবিতাটি সে পড়ে শোনায় সাংবাদিকদের।
যে যুবকটি এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের হোতা, তার সঙ্গে কী এমন বিবাদ ছিল কার্টারের? অথবা যে শ খানেক মানুষ হতাহত হলো, তাদের? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনো জানি না। এটুকু আমরা জানি, গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিজেই পুলিশকে ফোন করে জানিয়েছে, সে ইসলামিক স্টেটের একজন সমর্থক। সেই কথার ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছিল, কট্টর রক্ষণশীল হওয়ায় ধর্মীয় অনুশাসন মানতে গিয়ে সে সমকামীদের কাছে জনপ্রিয় এই ক্লাবটি বেছে নিয়েছে। তার বাবা, যে নিজে একজন তালেবান সমর্থক ও রক্ষণশীল মুসলমান, জানিয়েছে মাস দু-এক আগে মিয়ামিতে দুই সমকামী যুবককে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে সে ক্রোধান্বিত হয়েছিল। হতে পারে সেই ক্রোধ থেকেই এই নরককাণ্ড।
ক্রমেই যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে অবশ্য একটি ভিন্ন ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ জেনেছে, যুবকটি নিজেই এই সমকামী ক্লাবে ঘন ঘন যাতায়াত করত। একটি সমকামী ওয়েবসাইটের সাহায্যে সে বার কয়েক পুরুষ বন্ধু খুঁজে নিয়েছে। তাহলে কি যুবকটি নিজেই সমকামী ছিল? তা-ই যদি হয়, তাহলে অন্য সমকামীদের প্রতি এমন ভয়ানক ক্রোধ কেন?
এর উত্তর আমরা এখনো জানি না। তবে মনোবিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, নিজের সমকামী পরিচয় সে কখনো মেনে নিতে পারেনি। সে জানে তার পরিবার, কাছের বন্ধুবান্ধব অথবা নিজস্ব সম্প্রদায়ের কেউই তার সে পরিচয় মেনে নেবে না। ফলে তার মধ্যে দেখা দেয় গ্লানি ও আত্মঘৃণা। তার সঙ্গে যুক্ত হয় অবদমিত যৌন বাসনা। এ দুই বৈকল্য থেকে আসে একই সঙ্গে হত্যা ও আত্মহননের চিন্তা।
যুবকটি অসুস্থ ছিল, এ কথা তার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাবেক স্ত্রীও জানিয়েছে। সে বাই-পোলার ডিসঅর্ডার নামের মানসিক ভারসাম্যহীনতার সমস্যায় ভুগছিল, কখনো সুস্থ তো কখনো ভয়ানক আক্রমণাত্মক। তাকে সে প্রায়ই মারধরও করত, সে-কথা তার স্ত্রী জানিয়েছে।
ছেলেটি অসুস্থ, এটা তার পরিবারের সবার জানার কথা। তার বাবা নিজেই জানিয়েছেন, সমকামীদের ব্যাপারে তার প্রবল ঘৃণা ছিল। তাহলে কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না কেন? আমরা জানি, সমকামীদের প্রতি ঘৃণাপূর্ণ মনোভাব মুসলমানদের মধ্যে অপরিচিত কোনো ব্যাপার নয়। তথাকথিত ইসলামি স্টেটে সমকামিতার জন্য পুড়িয়ে মারা হয়েছে অথবা উঁচু ভবন থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে—এ তো সেদিনকার ঘটনা। সেই যুবককে বাধা দেওয়ার বদলে সমকামীদের প্রতি ঘৃণার জন্য হয়তো পরিবার ও সমাজ থেকে হাততালিই দেওয়া হয়েছে। সেই ঘৃণা যে এমন বিধ্বংসী আকার নেবে, এমন চিন্তা কারও মাথায় আসেনি।
কিন্তু মৃত্যুর আগে নিজে পুলিশকে ফোন করে সে ইসলামিক স্টেটের প্রতি আনুগত্য কেন প্রকাশ করল?
যুবকটির জঙ্গি মনোভাব ছিল, বিভিন্ন জিহাদি ওয়েবসাইটে সে প্রায়ই সময় কাটিয়েছে, গোয়েন্দারা সে তথ্য বের করেছে। জিহাদিদের সঙ্গে তার যোগসূত্র আছে, এই সন্দেহে পুলিশ তাকে বার দু-এক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তাকে অনেক দিন নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। কিন্তু সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকায় তাকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে হাজার হাজার যুবক ও কিছু যুবতী ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগ দিতে সিরিয়া ও ইরাকে পাড়ি দিয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু বাংলাদেশিও আছে। কোন কারণে বা কী প্রণোদনা থেকে তারা এমন ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়, তার কিছু ব্যাখ্যা এত দিনে আমরা সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবিশারদদের কাছ থেকে পেয়েছি।
পশ্চিম ইউরোপীয়দের বিষয়ে বলা হয়েছে, সমাজের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী এসব যুবক-যুবতী নিজের দেশেই পরবাসী। নিজের জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু করা সম্ভব, এমন একটা বিশ্বাস থেকে তারা ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে রণক্ষেত্রে যাত্রা করেছে। ইসলামিক স্টেট ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে তাদের কানে অনবরত বিষ ঢেলেছে, হাতে স্বর্গ এনে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। যারা ইরাক-সিরিয়া থেকে ফিরে এসেছে, তাদের কেউ কেউ স্বীকার করেছে যে ইসলামিক স্টেটের প্রচারণায় তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল।
অন্য আরেকটি কারণ, যা এখন ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে, তা হলো অফুরন্ত যৌন অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি। যেসব খোলামেলা সমাজ থেকে এরা এসেছে, সেখানে মুক্ত যৌন সংসর্গ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এসব যুবকের অধিকাংশই সেই অভিজ্ঞতায় শরিক হতে পারেনি, ফলে একধরনের বঞ্চনা তাদের মধ্যে কাজ করেছে। তারা ভেবেছে, ইসলামিক স্টেটে গেলে সেই সমস্যা মিটবে, সেখানে সাময়িক স্ত্রী বা ভিন্ন ধর্মের যৌনদাসী, কোনোটারই অভাব নেই।
কিন্তু অরল্যান্ডোর যুবকটির বেলায় এই ব্যাখ্যা খাটে না। সে ভদ্রগোছের চাকরি করত, বার দু-এক বিয়েও করেছে। ফলে এই হত্যাকাণ্ডের ভিন্ন ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে। শুধু মুসলমান নাম দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর মতো আরও অনেকে এটাকে আরেকটি জঙ্গি ইসলামি সন্ত্রাসী কাণ্ড হিসেবে যে দাবি করেছেন, তা সঠিক নয় বলে মনে হচ্ছে। এর পেছনে ইসলামিক স্টেটের অপ্রত্যক্ষ মদদ নেই, তা নয়; কিন্তু সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা ছিল তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। প্রেসিডেন্ট ওবামাও সে কথাই বলেছেন, যদিও সে কথা বলার জন্য ট্রাম্প তাঁকেও সন্ত্রাসীদের একজন বলে কষে গাল দিয়েছেন।
আমেরিকার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই গণহত্যাকাণ্ডের কারণে মার্কিনিদের মধ্যে মুসলমানবিরোধী মনোভাব বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে আশাতেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাঁর নিজস্ব জিহাদের মাত্রা কয়েক গুণ চড়িয়ে দিয়েছেন। মাস ছয়েক আগে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নাদিনোতে এক পাকিস্তানি দম্পতির হাতে সন্ত্রাসী ঘটনার পর ট্রাম্প সোল্লাসে বলেছিলেন, গণগোলাগুলি আমার খুবই পছন্দ। যখনই কোনো ট্র্যাজেডি ঘটে, তখনই আমার জনসমর্থন আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে।
সেই আশাতেই তিনি এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের অপরাধ পৃথিবীর সব মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।
তিনি ইঙ্গিত করেছেন, এই যুবক যে জঙ্গি, সে কথা তার ধারে-কাছের মুসলমানদের জানার কথা। কিন্তু তারা টুঁ শব্দটি করেনি। অতএব সঙ্গদোষে এ দেশের সব মুসলমানই এই সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। তিনি আমেরিকার সব মুসলমানের ওপর নজরদারি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট–এর ভাষ্যকার ডানা মিলব্যাংক সে কথায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এরপর হয়তো দাবি করা হবে প্রতিটি মুসলমানকে আলাদাভাবে চেনা যায় এমন পরিচয়পত্র বহন করতে হবে, হাতে বা বুকে চাঁদ-তারা সিল লাগিয়ে ঘুরতে হবে। তিরিশের দশকে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের যেমন বিশেষ পরিচয়পত্র নিয়ে রাস্তায় নামতে হতো।
এক উদ্বেগজনক সময়ে আমাদের বাস। বিশ্বের অনেক দেশেই মুসলমানবিরোধী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ তার একটি কারণ সন্দেহ নেই। অন্য কারণ অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন, যাঁকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কেউ কেউ ‘প্রতারক’ রাজনীতিক অভিহিত করেছেন, তিনি শুধু অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিজ দেশের শ্বেতকায়দের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। এটি পশ্চিমা গণতন্ত্রের অন্তর্গত দুর্বলতার এক প্রমাণ।
কিন্তু এ কথাই বা কী করে অস্বীকার করি, একজন মুসলমানের হাতে এমন গণগুলিবর্ষণের ঘটনার পর বিশ্বের কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে মার্কিন জনগণের সমর্থনে কোনো প্রকাশ্য নাগরিক সমর্থন অথবা এ ঘটনার প্রতি নিন্দা জানানোর ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে প্রধানমন্ত্রী মার্কিন জনগণের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আল-আজহার অথবা সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেননি।
প্যারিসে, সান বার্নার্দিনোতে অথবা অরল্যান্ডোয় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার প্রতিটি ঘটেছে ইসলামের নামে। একদল লোক ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের ধর্মকে ছিনতাই করতে চাইছে। এমন ঘটনার প্রতিবাদ সবার আগে তো তাদেরই করার কথা।
আরও একটি কথা। ওমর মতিন নামের যে যুবকটি এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী, চাই বা না চাই, সে আমাদেরই সন্তান। আশঙ্কা করি, সে-ই শেষ যুবক নয়, যার হাতে এমন নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের চোখের সামনে এরা বদলে যাচ্ছে, কতকাল বালুতে মাথা ডুবিয়ে আমরা তা না দেখার ভান করব?
১৬ জুন ২০১৬
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরেদৗস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।