দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন কেন বাংলাদেশ?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৩ প্রকাশ করেছে গতকাল। সূচকের শূন্য থেকে ১০০-এর স্কেলে ২৭ পেয়ে বাংলাদেশ ১৭৭টি দেশের মধ্যে ১৩৬তম অবস্থান পেয়েছে, যা তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী ২০১১ ও ২০১২ এবং প্রাপ্ত ১৩তম অবস্থানের তুলনায় তিন ধাপ ওপরে। গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ১ পয়েন্ট বেশি ও তালিকার ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থান ৮ ধাপ ওপরে। গত বছর বাংলাদেশ ২৬ পয়েন্ট পেয়ে ১৪৪তম স্থানে ছিল। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ২৭ স্কোর নিয়ে তালিকার উচ্চক্রম অনুযায়ী ১২০তম স্থানে ছিল। স্কোর ও অবস্থান অনুযায়ী গতবারের তুলনায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ এবারও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু আফগানিস্তান ছাড়া সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। সূচকে অন্তর্ভুক্ত অন্য পাঁচটি এ অঞ্চলের দেশ—ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান এগিয়ে রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে সর্বোচ্চ ৬৩ স্কোর পেয়ে তালিকার উচ্চক্রম অনুযায়ী ৩১তম অবস্থানে ভুটান, তারপর শ্রীলঙ্কা ৩৭ স্কোর পেয়ে ৯১তম স্থানে, ভারত ৩৬ স্কোর পেয়ে ৯৪তম, নেপাল ৩১ স্কোর পেয়ে ১১৬তম, পাকিস্তান ২৮ নম্বর পেয়ে ১২৭তম এবং আফগানিস্তান ৮ স্কোর পেয়ে গত বছরের মতো সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে বৈশ্বিক তালিকার সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সমান স্কোর পেয়ে এবার একই স্থান পেয়েছে আইভরি কোস্ট, গায়ানা ও কেনিয়া।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচক বা সিপিআই সরকারি খাতে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র দিয়ে থাকে। এটিকে যৌগিক সূচক বা জরিপের ওপর জরিপ বলা হয়, যার মাধ্যমে এক ডজনের বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের তথ্যের বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক অবস্থান নিরূপণের প্রয়াস করা হয়।
সিপিআই নিরূপণে এমন জরিপের তথ্যই ব্যবহূত হয়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। অতএব জাতীয়ভাবে টিআইবি বা এর মতো অন্য কোনো দেশের টিআই চ্যাপ্টারের গবেষণা বা জরিপলব্ধ কোনো তথ্য বা উপাত্ত এ সূচকে বিবেচিত হয় না। অন্যদিকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো দেশ সম্পর্কে কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক জরিপ থাকতে হবে।
এ বছরের জরিপে ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে তথ্য নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বেলায় যে সাতটি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো হলো: বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিং, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পারফরম্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অব ল ইনডেক্স। তথ্যের সময়কাল ছিল ফেব্রুয়ারি ২০১১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত।
এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আফগানিস্তান ছাড়া যেসব দেশের অবস্থান বাংলাদেশের তুলনায় নিম্নতর অবস্থানে রয়েছে, তাদের মধ্যে আছে লাওস, পাপুয়া নিউগিনি, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া। তা ছাড়া কাজাখস্তান, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, ইউক্রেন, তাজিকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভেনেজুয়েলা, হাইতি, ইয়েমেন, সিরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সুদানের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের তুলনায় কম স্কোর পেয়ে নিম্নতর অবস্থানে রয়েছে।
অন্যদিকে যেসব দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা সবচেয়ে কম বলে নিরূপিত হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে যৌথভাবে রয়েছে ৯১ স্কোর পেয়ে ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড। এরপর ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা।
কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশগুলোর অনেকেই, যেমন জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ইত্যাদি ৮০ শতাংশের কম স্কোর পেয়েছে। ১৭৭টি দেশের মধ্যে ১২৩টি, অর্থাৎ প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ দেশ ৫০-এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৯টি দেশ সূচকে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর প্রাপ্ত গড় স্কোর ৪৩ বা তার চেয়ে কম পেয়েছে।
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যদিও আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের তুলনায় দুর্নীতি অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পর পর পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতি ব্যাপকতার ধারণার এই সূচকে শীর্ষে অবস্থান করেছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০০৬ সালে তৃতীয়, ২০০৭-এ সপ্তম, ২০০৮-এ দশম, ২০০৯-এ ত্রয়োদশ, ২০১০-এ দ্বাদশ এবং ২০১১ ও ২০১২ সালে ত্রয়োদশ স্থান পাওয়ায় আন্তর্জাতিক তুলনামূলক অবস্থানের মাপকাঠিতে কিছুটা অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে আমাদের স্কোর ২০০১ সালে শূন্য থেকে ১০-এর স্কেলে শূন্য দশমিক ৪ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ২০১০-এ ২ দশমিক ৪ পর্যন্ত বাড়ে। পরবর্তী তিন বছরে অর্থাৎ ২০১১-২০১৩ পর্যন্ত সার্বিকভাবে কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে ২৬-২৭-এর মধ্যে স্থবিরতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি এর চেয়ে ভালো করতে পারি না? যেসব কারণে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি, তার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদ্যোগ সত্ত্বেও কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্তের ঘাটতি, বিশেষ করে পদ্মা সেতু প্রকল্প, রেলওয়ের নিয়োগ-বাণিজ্য, শেয়ারবাজার, হল-মার্ক ও ডেসটিনির মতো ‘রুই-কাতলা’ শ্রেণীর দুর্নীতির ঘটনাপ্রবাহ।
ক্ষমতাবানদের একাংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ বা সহায়তায় ভূমি-বনাঞ্চল-নদী-জলাশয় দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে টেন্ডারবাজিসহ আইনের শাসন পরিপন্থী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বেই রয়ে গেছে। জনপ্রতিনিধিরা ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিতজনেরা তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশের প্রতিশ্রুতি পূরণ থেকে বিরত থেকেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার অঙ্গীকারের বিপরীতে একগুচ্ছ সংশোধনী প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে সরকারের পুরো মেয়াদকালে কমিশনকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে রেখে প্রায় অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুদককে অনেক সময়ই দেখা গেছে সরকারের এক প্রকার বি-টিমের ভূমিকা পালন করতে। সংসদের শেষ অধিবেশনে সংবিধান ও সরকারের নিজস্ব নির্বাচনী অঙ্গীকার পরিপন্থী অবস্থান নিয়ে দুদক আইন সংশোধন করে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে দুদকের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দিয়ে দুদককে বাস্তবে অকার্যকর করে দেওয়া হলো।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একদিকে যেমন বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত দৃঢ়তা ও সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি, অন্যদিকে অনেক সময়ই সরকারের অবস্থানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই নিজেকে উপস্থাপন করেছে। তা ছাড়া যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগসংক্রান্ত অসংখ্য মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা আইনের শাসনের যেমন পরিপন্থী, তেমনি বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রক্রিয়াকে উদ্বেগজনকভাবে গভীরতর করেছে।
গণতান্ত্রিক জবাবদিহি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্যতম প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ। বিরোধী দলের কেবল আসন সংরক্ষণের স্বার্থে উপস্থিতির বাইরে ধারাবাহিকভাবে সংসদ বর্জনের ফলে সংসদ রূপান্তরিত হয়েছে সরকারি দল ও জোটের একচ্ছত্র ভুবনে। তদুপরি সংসদীয় কমিটিতে অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে সংসদ ব্যর্থ হয়েছে তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে, বিশেষ করে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। একদিকে সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং অন্যদিকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে পদদলিত করে নির্লজ্জভাবে কালোটাকা অর্জনকে পুরস্কৃত করা অব্যাহত রয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্বাচনী অঙ্গীকার ও সর্বোচ্চ পর্যায়সহ বহুমুখী রাজনৈতিক ঘোষণা ফাঁকা বুলি রয়ে গেছে। অন্যদিকে সরকারের নীতিকাঠামো ক্রমাগতভাবে দুর্নীতি-সহায়ক এবং দুর্নীতিতে লাভবান ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়দানকারী মহলের করাভূত হতে চলেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়তো আবারও ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘দৃঢ় অবস্থান’ ঘোষণা করে জনগণের ভোট আদায়ের ‘ঐকান্তিক’ প্রয়াসে লিপ্ত হবে। নির্বাচনের পর ক্ষমতায় যাঁরা আসবেন, তাঁরা খুব সহজে নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে সরে আসবেন, এমনটি আশা করার খুব বেশি যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তবু আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিবিরোধী আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টিতে যতটুকুই অগ্রগতি ইতিমধ্যে হয়েছে, তার কার্যকর প্রয়োগের ঘাটতির দায় যাঁরা পর্যায়ক্রমে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করছেন, মূলত তাঁদেরই নিতে হবে। জনগণকেও আরও সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে। জনগণই চাইবে দুর্নীতি প্রতিরোধক জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হোক; দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা পেশাদারির সঙ্গে ও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে কার্যকর হোক, যেন বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিস্তার প্রতিহত করা যায়। এই দাবি যত বেশি কার্যকর পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে, আর রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় স্বার্থকে যত কার্যকরভাবে অন্য সব বিবেচনার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে সক্ষম হবেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ততই বেগবান হবে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।