তনুকে কেউ খুন করেনি!

নিহত কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মা আনোয়ারা বেগম গত সোমবার আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘গরিব বলে কি বিচার পাব না? এভাবে মেরে ফেলবে?’ (প্রথম আলো, ২১ জুন, ২০১৬)
তাঁর অভিযোগ, তনুর বাবা ইয়ার হোসেনকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁদের মেয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা না বলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে তাঁর বড় ছেলে কুমিল্লায় যাচ্ছেন না বলেও জানালেন আনোয়ারা বেগম।
সন্তানহারা মা-বাবার জন্য এই অভিজ্ঞতা যে কত নির্মম, সেটি ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না।
তনুর মা-বাবার দাবি কী? তাঁরা কি সরকারের বা কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন? মোটেই না। তাঁরা সন্তান হত্যার বিচার চেয়েছেন। একটি মেয়ে দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায় ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে এলেন না। পরে জঙ্গলে তাঁর লাশ পাওয়া গেল। যে দেশে আইনের শাসন আছে বলে দাবি করা হয়, সেই দেশে তো যেকোনো নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।
তাহলে তনুর মা-বাবার ওপর এই চাপ কিংবা হুমকি কেন?
তনু ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক সম্মানের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে একটি নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভালো গান গাইতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। এ রকম একজন গুণী মানুষ একটি সুরক্ষিত এলাকা থেকে নাই হয়ে গেলেন!
এটি কি মানা যায়? না, যায় না বলেই দেশবাসী প্রতিবাদ করেছে। সহপাঠী শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। মাননীয় আদালতও হস্তক্ষেপ করেছেন। কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও গত তিন মাসে তনু হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটিত না হওয়া কিংবা কোনো আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। যে চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা কিছু বলতে পারলেন না। তদন্তকারী সংস্থা কিছু জানাতে পারল না। কেউ গ্রেপ্তার হলো না।
এটি কী করে সম্ভব? তনুর মরদেহ যখন জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া গেল, তখন তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ফরেনসিক রিপোর্টে তাঁকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রথম ময়নাতদন্তে দায়িত্বে নিয়োজিত চিকিৎসক মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করলেন না। এমনকি তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল, তাও চেপে গেলেন। এরপর আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হলো। এবারেও চিকিৎসকেরা মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটন করতে ব্যর্থ হলেন। বললেন, লাশ গলে যাওয়ায় মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। কিন্তু প্রথম ময়নাতদন্তের সময় তো লাশ অক্ষতই ছিল। ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করতে বললেন, ‘যৌনসংসর্গ’ হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় নাকি ধর্ষণ বলে কিছু নেই। নিশ্চয়ই চিকিৎসাশাস্ত্রে হত্যা বলেও কিছু নেই। আছে সিভিয়ার ক্যাজুয়ালটি বা গুরুতর আঘাত পাওয়া। ওই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা দেশের মানুষকে নির্বোধ ভাবছেন। সবার চোখে ধুলো দিতে চাইছেন। পরবর্তী ময়নাতদন্তে হয়তো তাঁরা তনুর অস্তিত্বই অস্বীকার করবেন। বলবেন, তনু নামে কেউ পৃথিবীতে ছিলেন না।
কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত, চিকিৎসা পেশাটি আর পাঁচটি পেশার মতো নয়। যে পেশার সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক, সেই পেশার মানুষকে আরেকটু দায়িত্বশীল হতে হয়। এই দেশেই অনেক মহৎ চিকিৎসক জন্ম নিয়েছেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রোগীর চিকিৎসা করেছেন। ১৯৭১ সালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ফজলে রাব্বীকে জীবন দিতে হয়েছে। হত্যার আগে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি কেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারকে চিকিৎসা করিনি। চিকিৎসা করেছি আহত মানুষকে।’
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে চিকিৎসকেরা তনুর ময়নাতদন্ত করেছেন, তাঁরা এই পূর্বসূরির উদাহরণটি মনে রাখলে খুশি হব।
তনু হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং অপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ হলেও আমাদের ডিবি, আমাদের সিআইডি, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে কোথাও তনুর হত্যাকারীদের কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। তিন মাস ধরে তাঁরা খুঁজছেন। তদন্ত করছেন। কিন্তু কিছুই বের করতে পারেননি। তাঁরা বের করতে পারেননি, কারা তনুর শরীরে আঘাত করেছে।
তাহলে কি আমরা ধরে নেব, তনু হত্যার ঘটনা নিছকই অপপ্রচার? তাহলে কি আমাদের মেনে নিতে হবে, তনুকে কেউ খুন করেনি। তনু নিজে নিজেই ‘নিহত’ হয়েছেন। পৃথিবীতে আত্মহত্যা বলে একটি বিষয় আছে। কিন্তু নিজে নিজে নিহত হওয়াকে ঘটনা নেই।
আর তনুকে যখন কেউ খুনই করেনি, তাহলে তদন্তকাজও বন্ধ করা উচিত নয় কি? তবে এও সত্য যে কিছু সময়ের জন্য কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করা গেলেও সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই। আমরা সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতির ঘাতকদেরও খুঁজে বের করতে পারিনি। তাহলে কি মেনে নিতে হবে, তাঁদেরও কেউ খুন করেননি?
এ প্রসঙ্গে বলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’র কথা মনে পড়ল। ছবির কাহিনি এ রকম: জেসিকা লাল নামে দিল্লিতে এক মডেল ও রেস্তোরাঁকর্মী ছিলেন। তিনি যে রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন, একদিন দুই সহযোগীসহ মনু শর্মা নামের এক ব্যক্তি সেখানে ঢুকে তাঁকে মদ পরিবেশন করতে বলেন। কিন্তু তখন বার বন্ধ হয়ে গেছে। জেসিকা তাঁদের মদ পরিবেশনে রাজি হননি। এরপর মনু শর্মা ক্ষিপ্ত হয়ে রেস্তোরাঁভর্তি লোকের উপস্থিতিতে জেসিকাকে গুলি করে হত্যা করে। সেটি ছিল ১৯৯৯ সালের ঘটনা। কিন্তু যখন এ নিয়ে মামলা হলো তখন রেস্তোরাঁয় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। কেউ ঝামেলা এড়াতে, কেউ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। ফলে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাটির অপমৃত্যু ঘটে এবং ২০০৬ সালে মনু শর্মা বেকসুর খালাস পান।
তিনি ছিলে হরিয়ানার ধনাঢ্য মুখ্যমন্ত্রী ভুপেন্দর সিংয়ের সন্তান। মামলায় যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছিল, সেটিও সবার জানা। এরপর এ নিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়। এ কাহিনি নিয়ে ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ বা ‘জেসিকাকে কেউ খুন করেনি’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করেন রাজ কুমার গুপ্তা। এরপরই চারদিকে হইচই পড়ে যায়। মামলার পুনঃ তদন্ত হয় এবং অপরাধী সাব্যস্ত করে আদালত মনু শর্মাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
সেই মামলা ছিল ক্ষমতাবান পক্ষের সঙ্গে জেসিকার পরিবার, তথা বোন সাব্রিনার নজিরবিহীন লড়াই। সন্তান হত্যার বিচার পেতে তনুর মাকেও হয়তো সাব্রিনার ভূমিকায় নামতে হবে। না হলে স্বার্থান্বেষী মহল এটাই প্রমাণ করবে যে ‘তনুকে কেউ খুন করেনি’।