এ কোন নিরপেক্ষতায় সুশীল সমাজ?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটিতে গতকাল ক্যাম্পাস ছেড়ে যান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটিতে গতকাল ক্যাম্পাস ছেড়ে যান

এই লেখা এমন একটি সময়ে লিখতে বসেছি, যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে অবরুদ্ধ। অবশ্য পরে তাঁরা পুলিশের পাহারায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এর আগে তাঁদের টিভি ও ইন্টারনেটের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু সময়জুড়ে বিদ্যুৎ ছিল না। শোনা গিয়েছিল, পানির লাইনও কেটে দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো একভাবে পানি সরবরাহ এখনো চলছে। ভবিষ্যতে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। বাসভবনের মূল ফটকের সামনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা তাঁবু গেড়ে অবস্থান নিয়েছেন। ছাত্র পরিচয়ধারী অনেক ব্যক্তিও অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে আধা ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে তা না করলে বাসায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। উপাচার্যকে আরও বলা হয়েছে, তাঁকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে বাইরে ফেলে আসা হবে। এই কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সহ-উপাচার্যকে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা ১২ দিন অবরোধ করে রাখলেন তাঁদের দাবি আদায়ের জন্য।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আমার প্রয়াত স্বামী কর্নেল আবু তাহেরের (বীর উত্তম) ছোট ভাই। পরিবারের একজন সদস্য এভাবে আক্রান্ত। সে কথা ভেবেই আমি গিয়েছিলাম বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম এই বলে যে আপনি কিছু একটা বলুন, এভাবে একজন ব্যক্তিকে দিনের পর দিন আন্দোলনের নামে আটকে রাখা যায় না। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে প্রতিনিয়ত অপদস্থ করা যায় না, অপমান করা যায় না। তিনি বললেন, তিনি একটি বিবৃতি দিতে পারেন। তার সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, ব্যাপারটি জাহাঙ্গীরনগরের দুই পক্ষের মধ্যে ঘটনা। রাষ্ট্র এখানে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি। ফলে এ বিষয়ে তাঁর তেমন কিছুই করার বা বলার নেই।
মিজানুর রহমান সাহেবের কথাগুলো শুনে বিচলিত বোধ করছিলাম। জানতে পেরেছি, মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা আছে: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯-এর ২ (চ) ধারা অনুসারে ‘মানবাধিকার’ অর্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত কোনো ব্যক্তির জীবন (life) অধিকার (liberty) সমতা (equality) ও মর্যাদা (dignity) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার। কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কর্তৃক আপনার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে বা লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আপনি নিজে বা আপনার পক্ষে অন্য কেউ মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করতে পারেন।”
আমি প্রাণরসায়নের ছাত্রী, তাই আইনের মারপ্যাঁচ অত বুঝি না। তার পরও কথাগুলো আমার কাছে পরিষ্কার মনে হয়েছে। কথাগুলো পড়ে মনে হয়েছে, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে দিনের পর দিন আটকে রেখে তাঁর ওপর বল প্রয়োগ করে পদত্যাগ আদায় করতে গিয়ে তাঁর মানবাধিকার নিশ্চিতভাবেই লঙ্ঘিত হয়েছে।
কয়েক মাস আগে ঠিক এমনিভাবে অধ্যাপক আনোয়ারকে তাঁর কার্যালয়ে অবরোধ করে রেখেছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা অধ্যাপক আনোয়ারকে তাঁর কার্যালয় থেকে ৮৫ ঘণ্টা পর মুক্তি দিয়েছিলেন। এর অনেক আগেই উপাচার্য নিজেই দাবি করলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সেই অনুরোধ তিনি করেছিলেন।
আনোয়ারের মানসিক অবস্থাটা আমি বুঝি। নিজ গুণেই আনোয়ার সারাটা জীবন একজন সৎ ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এবং একজন ভালো শিক্ষক হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে হোক, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে হোক বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ডিপার্টমেন্ট হিসেবে পরিচিত বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে হোক—সব জায়গাতেই আনোয়ার একজন দক্ষ ও সৎ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এক বাক্যেই তা সবাই স্বীকার করবেন। পৃথিবীর সেরা সব গবেষণাগ্রন্থে তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার খবর যখন পেতাম, বুকটা গর্বে ভরে উঠত।
তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে সরকার-সমর্থিত শিক্ষকদের একাংশ যখন সরাসরি বিরোধীদলীয় ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এনে তাঁর পদত্যাগ চাইলেন; আমি নিশ্চিত, আনোয়ার তখন গভীরভাবে বেদনাক্রান্ত হয়েছিলেন। দ্রুত দাবি করেছিলেন একটি তদন্ত কমিশন গঠনের। তিনি আরও বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করবেন। তবে যদি সত্যতা পাওয়া না যায়, তিনি দ্রুততম সময়ে বহুল প্রতীক্ষিত জাকসু নির্বাচনসহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেটের ব্যবস্থা করবেন, যে সিনেট নতুন উপাচার্য নির্বাচন করবে। সেই নির্বাচনে অধ্যাপক আনোয়ার অংশগ্রহণ করবেন না।
সেই তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশন তদন্ত সম্পন্ন করেছিল দ্রুততম সময়ে এবং প্রতিবেদনও পেশ করেছিল। কিন্তু দুঃখের কথা, আজও সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। পত্রিকায় পড়েছি, অপ্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো অধ্যাপক আনোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত। উপাচার্যের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য না হলে প্রতিবাদের একটি ভাষা আছে। ১৯৭৩-এর আইনে প্রতিবাদের বিধান আছে। কিন্তু কোনো রকমের আইনের তোয়াক্কা না করে যেভাবে বাংলাদেশের একমাত্র নির্বাচিত উপাচার্যকে হেনস্তা করা হচ্ছে, গালিগালাজ করা হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মিথ্যাচার প্রচার করা হচ্ছে, আটকে রেখে জোর করে পদত্যাগের দাবি করা হচ্ছে, তা আসলে কতটুকু মানবিক? কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী সংসদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি আন্দোলন সম্পর্কে বললেন, এভাবে আইন অমান্য করতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। সে কথা শুধু কথা হিসেবেই রয়ে গেছে। আমাদের সুশীল সমাজের কি এ বিষয়ে কিছুই বলার নেই। আপনারা অধ্যাপক আনোয়ারের পক্ষ না নিন, অন্তত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হোক, সেই দাবিটি করতে এত কুণ্ঠিত বোধ করছেন কেন? এভাবে একজনকে অপদস্থ করা যে যায় না, সে বিষয়ে কি আপনাদের কিছুই বলার নেই?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের সাহস দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। একমাত্র তিনি এবং হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সুশীল সমাজের কেউই জাহাঙ্গীরনগরের অচলাবস্থা সম্পর্কে কথা বলছেন না। আইনের শাসনের পরিপন্থী কাজের প্রতিবাদ করছেন না। আজকে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ কেমন নিরপেক্ষতা আপনাদের?
লুৎফা তাহের: কর্নেল আবু তাহেরের স্ত্রী।