আমাদের ভাবনা ও দুর্ভাবনা

.
.

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সেমিনার হয়েছে। এর মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষায় যে নানা রকম পরিবর্তন ও পরীক্ষণ করা হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। জাপান, কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনাম শিক্ষাকে যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে চলেছে, সেই তুলনায় আমাদের উদ্যোগ কেবলই বাজেট বরাদ্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা–ও আবার বিগত পাঁচ-ছয় বছর জিডিপির যে ভগ্নাংশ শিক্ষায় ব্যয় হয়, তার পরিমাণ কমছে। তা হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের কারণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের এই ভূখণ্ডে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের দিয়ে বেশ কিছু শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। সাম্প্রতিকতম শিক্ষানীতিটিও প্রণীত হয়েছে ছয় বছর আগে এবং কেবল তার বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হয়েছে।
উল্লিখিত সেমিনারে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে আমার খণ্ডিত মতামতও নিম্নে পেশ করছি:
১. শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। অনেক দেশই যেমন কিউবা কিংবা ডেনমার্ক এর চেয়ে বেশি ব্যয় করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক বছর শিক্ষাবান্ধব শিক্ষামন্ত্রীর আমলে আমাদের শিক্ষা ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ২-এর নিচে নেমে এসেছে। এর জন্য আমাদের সম্পদের অপ্রতুলতা যেমন দায়ী, ঠিক তেমনি দেশের অগ্রগতিতে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়।
২. উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোর ভৌত অবকাঠামো, গবেষণাগার ও শিক্ষকের মান উন্নত নয়, হওয়ারও কথা নয়। সুতরাং এই অভাব পূরণ করতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য চাই চমৎকার পাঠ্যপুস্তক। যে পাঠ্যপুস্তকের ১০ লাখ কপি ছাপা হবে তা তো যেকোনো লেখককে দিয়ে লেখানো যাবে না। অত্যন্ত প্রথিতযশা নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদদের সারা জীবনলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তা রচিত হবে। সেই পুস্তকটি আমরা অহরহ পরিবর্তনও করতে পারি না। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অহরহ এমন বৈপ্লবিক অগ্রগতি হবে না, যা আমাদের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্রদের জানাতে হবে। তারা মৌলিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান ভালোভাবে রপ্ত করবে।
৩. আমাদের সম্পদ সীমিত, তবে এই সীমিত সম্পদের মূল্য সংযোজন সবচেয়ে বেশি হবে যদি তা মানবসম্পদের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। এ জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। টেলিভিশনে শিক্ষা চ্যানেলের মাধ্যমে সময়সূচি অনুযায়ী সারা বছর বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদান যদি দক্ষ, অভিজ্ঞ ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিক্ষকদের দিয়ে করানো হয়, তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুযোগ্য শিক্ষক ও বঞ্চিত ছাত্রদের মনোবল যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনি কঠিন ধারণাসমূহ আয়ত্ত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৪. যে প্রশ্নে ১৫-২০ লাখ ছাত্রের মূল্যায়ন করা হবে, তা হতে হবে দীর্ঘ গবেষণার ফসল। আমরা গতানুগতিক নয়, সৃজনশীল প্রশ্ন করে যেমন ছাত্রদের দুর্বল দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে পারি, ঠিক তেমনি তাদের যেকোনো বিষয়ের মৌলিক ধারণাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে উৎসাহিত করতে পারি। উন্নত বিশ্বের অনেক প্রশ্নপত্রেই দেখেছি, সমস্যা সমাধানের জন্য যেসব তত্ত্ব ব্যবহার করতে হবে, তার তালিকা প্রশ্নের অপর পাশে দেওয়া থাকে, ফলে সেগুলো মুখস্থ করতে হয় না। তবে এর জন্য তাদের সৃজনশীল হতে হয়।
৫. গুটি কয়েক ভালো স্কুল-কলেজের চাহিদা এত বেশি যে টঙ্গী থেকে ভিকারুননিসা কিংবা নটর ডেম কলেজে ভর্তি করাতে পারলেও বাবা-মায়ের খুশির অন্ত নেই। অথচ এর জন্য কত অপচয় হয় তার খোঁজ আমরা রাখি না। শুধু উন্নত দেশে নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও শিক্ষায়তনের নৈকট্যের বিবেচনায় ভর্তির বিধান রয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে স্কুল-কলেজে ভর্তি এলাকাভিত্তিক করা উচিত। সরকার ইতিমধ্যে প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির বিষয়ে লটারি-ব্যবস্থার সূচনা করে কোমলমতি শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ থেকে রেহাই দিয়েছে। তবে এখন প্রয়োজন মহানগরভিত্তিক সমন্বিত ভর্তিব্যবস্থা।
৬. ভর্তি পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কিংবা মূল্যায়নে কোচিং সেন্টারের ভূমিকা নেই বলেই বিশ্বাস করতে চাই। আর তা ছাড়া আমাদের সম্পদের অপ্রতুলতার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করা নিষ্প্রয়োজন। বরং আমরা যেন এমনভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করি কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করি, যাতে করে কোচিং সেন্টারের শিখিয়ে দেওয়া তোতা পাখির বুলিতে পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়া না যায়।
৭. শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ কম বলেই নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে অফুরন্ত প্রাণশক্তির কিশোরদের দক্ষতা ও জ্ঞানার্জনে উৎসাহ দিতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত জিপিএ-ব্যবস্থা আমাদের ছাত্রদের সামর্থ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। ৮৫ আর ৮৬-এর মধ্যে তেমন তফাত নেই, তাই ভুল কমাতে আমরা জিপিএ–ব্যবস্থা প্রবর্তন করলাম। কিন্তু এখন ৭৯ আর ৮০-এর সামান্য ফারাক এত বড় হয়ে দেখা দিল, তার
থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? যত বেশি ধাপ স্বভাবতই ভুল তত বেশি, যদিও ভুলের মাত্রা কম। যত কম ধাপ তত কম ভুল, তবে ভুলের মাত্রা অনেক বেশি। যে মূল্যায়নে লাখো ছাত্রের মেধাকে সমানে সমান মনে হয়, সেটা যে আদৌ মূল্যায়ন নয়, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৫ শতাংশ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ছাত্রের ফেল করা থেকে পরিষ্কার।
৮. আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারব না, গত ৩০ বছরে ঢাকা বোর্ডের কোন ছাত্রটি পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল কিংবা অন্যান্য বিষয়ে কিংবা সারা দেশে। এমনকি ওই ছাত্রকেও নিশ্চয়ই আমরা এ তথ্যটি জানাইনি। তাকে গর্বিত হওয়ার সুযোগ দিইনি। কথা হচ্ছে, ভালোকে শতকণ্ঠে ভালো বলতে হবে। প্রতিযোগিতা ছাড়া উৎকর্ষ অর্জন করা যায় না। সীমিত সম্পদের দেশে প্রতিযোগিতা হলো উৎকর্ষ অর্জনের জন্য সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী পদ্ধতি। দীর্ঘদিন গণিতের অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। যেই ক্লে ম্যাথমেটিকস ইনস্টিটিউট মিলেনিয়াম সমস্যার প্রতিটি সমাধানের জন্য এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করল, সঙ্গে সঙ্গে একটি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
৯. প্রশ্নপত্র ফাঁস আরেকটি হতাশাব্যঞ্জক বিষয়, যা গোটা জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ বিষয়টি এখন এমনকি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে বাবা-মায়ের দৌড়ানো যে আমাদের কোমলমতি শিশুদের মূল্যবোধের ওপর কত বড় আঘাত, তা আমরা শিগগিরই বুঝতে পারব। নানাভাবেই এ প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। সরকার এই ফাঁস ঠেকাতে না পারলে সেটা তারই ব্যর্থতা। আমাদের যথেষ্ট বড় একটি প্রশ্নপত্রের ব্যাংক থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে পরীক্ষার ঘণ্টা খানেক আগে প্রশ্ন তৈরি করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে পাঠিয়ে দিলেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যায়। শুধু কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপানো ও ফটোকপির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
১০. বর্তমান সরকার লটারির মাধ্যমে প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির ব্যবস্থা করে ছোট্ট শিশুদের অনভিপ্রেত চাপের হাত থেকে মুক্ত করেছে। তবে এই ভর্তি যদি বিশেষ করে মহানগরসহ অন্যান্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সমন্বিতভাবে সব স্কুলের জন্য একযোগে করা যায়, তাহলে সুফল অনেক বেশি পাওয়া যাবে। এর ধারাবাহিকতায় গতবার কলেজে ভর্তি সব কলেজের জন্য সমন্বিতভাবে হয়েছিল। প্রথমবার সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে কম্পিউটার প্রক্রিয়াকরণে ভুলত্রুটি ছিল। কিন্তু এতে মানুষের ভোগান্তি ও অপচয় কমেছে। এর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড কর্তৃপক্ষ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। এবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন ছাত্রকে তার পছন্দের তালিকার সব কলেজেই মেধানুসারে নিয়মানুযায়ী তালিকাবদ্ধ করায় তালিকার নিম্নে স্থানপ্রাপ্ত ছাত্রদের ভোগান্তি যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনি স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তবে এই পদ্ধতিতে ভর্তির গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে আমরা পাবলিক পরীক্ষাগুলোকে কতটা কার্যকর করতে পারছি তার ওপর।
আমরা যদি ভালো প্রকৌশলী হতে পারি, তাহলে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে না। আমরা যদি ভালো চিকিৎসক হতে পারি, তাহলে আমাদের রোগীকে আর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে না, নিজের দেশের চিকিৎসক আর হাসপাতালই আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে। শ্রেয়তর শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের তরুণেরা বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন করবে, আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাব। আত্মমর্যাদাবোধে বলীয়ান হয়ে সারা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।