বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমা

হলি আর্টিজান: এই উন্মাদনা অব্যাহত থাকতে পারে না
হলি আর্টিজান: এই উন্মাদনা অব্যাহত থাকতে পারে না

প্রশ্নহীন আনুগত্য, পরম বিশ্বাস বা কারও ওপর পুরোপুরি ভর করে থাকা অনেক আরামদায়ক। বিশ্বাস ভরসা দেয়, আশ্রয় দেয়। অনেক উদ্বেগ থেকে বাঁচায়। নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার বোধ এনে দেয়। মানুষের এই বিশ্বাস ধর্মবিশ্বাস থেকে শুরু করে সরকার, নেতা, মা-বাবা, শিক্ষক, কোম্পানি, মিডিয়া, বস পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। শিশুরা যে নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ থাকতে পারে, তার বড় কারণ তাদের কাছে দুনিয়ার অনেক তথ্য থাকে না, তা ছাড়া তারা পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে মা-বাবার আশ্রয়ে নির্ভার থাকে। একটু বড় হলে সেই বিশ্বাসের মধ্যে একটু ফাটল ধরতে পারে, কিংবা মা-বাবার ওপর বিশ্বাস তার কাছে যথেষ্ট মনে না-ও হতে পারে। দুনিয়ার আরও তথ্য তার কাছে আসে। তখন ক্রমে শিক্ষক, বন্ধু, পরিচিত জন, বই, টিভি, কম্পিউটার পর্যন্ত তার বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কারও ওপর একক বিশ্বাস থাকলে নিশ্চিন্ত, না হলে তার মস্তিষ্ক সক্রিয় করতে হয়। পড়তে হয়, দেখতে হয়, পর্যালোচনা করতে হয়, বিতর্কে ঢুকতে হয়। মা-বাবা, শিক্ষক, নেতা, মিডিয়া সবাইকে প্রশ্ন করতে সক্ষম হয়ে ওঠে তখন। তার সাবালকত্ব আসতে থাকে।
আমরা ইচ্ছা করলেই সব ক্ষেত্রে আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে নানা ঘটনা, নানা শক্তি আমাদের জীবন প্রভাবিত করে। কোনো কোনো উপাদান জীবন সমৃদ্ধ করে, কোনো কোনোটি জীবন বিপর্যস্ত করে। যে রাষ্ট্রে আমরা বাস করি তার সরকারের ভূমিকা হচ্ছে সীমানার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমান কালে সরকারের এ ভূমিকা এককভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সেখানে বৈশ্বিক নানা শক্তির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ভূমিকা মানুষের জীবনকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে। ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা, ফিলিস্তিনে কিছুদিন পরপর গণহত্যা, ভারত-পাকিস্তানে সহিংসতা সবই আমাদের স্পর্শ করে। এগুলো কে কীভাবে দেখতে সক্ষম, তার ওপর প্রতিক্রিয়াও নির্ভর করে। অন্ধবিশ্বাস অনেক কিছুই বুঝতে দেয় না।
আফগানিস্তানে সেক্যুলার সরকার সরিয়ে প্রথমে মুজাহিদীন ও পরে তালেবানদের ক্ষমতায় বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তখন বিশ্বের অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেছে, যুক্তরাষ্ট্র মুসলমানদের পক্ষে কাজ করছে। এই বিশ্বাস থেকে তারা সন্তুষ্ট থেকেছে। বাংলাদেশ থেকেও মার্কিন তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তানে জিহাদ করতে গেছে মানুষ। ১৯৯১ সালে প্রথম ইরাকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা হয়েছে, এর পরের ১২ বছর অবরোধ জারি করে এই দেশকে শুকিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে। অসংখ্য মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।
কয়েক লাখ শিশুর অকালমৃত্যু ও হত্যার প্রশ্ন তুলে যখন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিবকে এর যৌক্তিকতা জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন, তারা যে মহান উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ পরিচালনা করছেন তাতে এটি যুক্তিযুক্ত। বিশ্বের অনেকেই তখন এই যুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। যাঁরা পেরেছিলেন, তাঁদের কাছে অসংখ্য শিশুর আর্তচিৎকার পৌঁছাতে পারেনি। মার্কিন প্রশাসন ইরাকে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাল ২০০৩ সালে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ইরাক। ১৫ লাখের অধিক মানুষ নিহত হলো। পুরোনো সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হলো। নানা গোত্র-তরিকায় সংঘাত শুরু হলো। লিবিয়া তছনছ হলো। ইরাক-লিবিয়ায় সেক্যুলার সরকার উচ্ছেদ করে পশ্চিমারা ইসলামপন্থী সরকারকে ÿক্ষমতায় বসাল।
এসব দখল-গণহত্যার পেছনেও যুক্তির কমতি ছিল না, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের প্রতি বিশ্বাসী মানুষদের সমর্থনও ছিল উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য দুনিয়ার সবাইকে জানাল, ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে, ভয়ংকর সাদ্দাম এই অস্ত্র ব্যবহার করে সারা দুনিয়াকে শেষ করে দেবে। সুতরাং বিশ্বশান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, বিশ্বকে আরও নিরাপদ করার জন্য এই যুদ্ধ অপরিহার্য। এসব প্রচারণায় যাঁরা বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছেন, ধ্বংস-গণহত্যা তাঁদের কোনোভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। টিভিতে একটি বিশাল জনপদের ওপর ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিক্ষেপের দৃশ্যও তাঁদের কাছে আনন্দদায়ক আলোকসজ্জার মতো মনে হয়েছে। তাঁরা বুশ-ব্লেয়ারের বক্তৃতা শুনেছেন পরম বিশ্বাস নিয়ে। উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদস্থ বহু মানুষ রাজশক্তির প্রতি অটল বিশ্বাস নিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়েছেন। সবশেষে সিরিয়ায় সরকার উচ্ছেদে সৌদি-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ প্রকল্পে কাজ শুরু হলো। একপর্যায়ে তৈরি হলো আইএস। বিশ্বজুড়ে বর্বর নানা ঘটনায় আতঙ্কের জালে আটকে যেতে থাকল মানুষ।
কিন্তু সবাই তো এ রকম বিশ্বাসী নন। যাঁরা বিশ্বাস করেননি, তাঁরা তখনই এদের যুদ্ধাপরাধী বলেছেন। যাঁরা বুঝেছেন এসব হামলা, গণহত্যা, যুদ্ধ বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র বা মানুষকে সহায়তা করার জন্য নয়, যাঁরা এসব ঘটনার পেছনে দেখেছেন মিথ্যাচার, প্রতারণা, জনবিধ্বংসী কাজ করে কিছু গোষ্ঠীর বাণিজ্য মুনাফার মতলব, দেখেছেন দখল-লুণ্ঠনের সঙ্গে বর্ণবাদ-সাম্প্রদায়িকতা, তাঁদের পক্ষে শান্তিতে থাকার উপায় ছিল না। যাঁদের দেখার মতো চোখ ছিল, বিশ্লেষণের ক্ষমতা ছিল, প্রচারিত খবরের বাইরেও যাঁরা চোখ দিতে পারতেন, তাঁদের জন্য ছিল ক্ষোভ আর অশান্তি। বোকার শান্তির মধ্যে তাঁরা বাস করেননি, কালক্রমে প্রমাণিত হয়েছে, এই অবিশ্বাসীরাই সঠিক ছিলেন।
১ জুলাই যারা গুলশানে নৃশংস ভয়ংকর এক অধ্যায় তৈরি করল, তাদের সম্পর্কে যা জানা যায় তাতে তাদের এই ভূমিকার পেছনে কাজ করেছে এমন এক বিশ্বাসকাঠামো, যা তাদের এই অসম্ভব ভূমিকায় নামিয়েছে। নানা দেশের নিরস্ত্র নারী-পুরুষ, যাদের তারা চেনে না, জানে না; তাদের ভয়ংকর শত্রু ভেবে, তাদের নির্যাতন ও হত্যায় তাদের হাত কাঁপেনি। তাদের মতো আরও কিছু লোক যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অজানা–অচেনা মানুষ হত্যা করছে শিশু-নারীসহ, তাদের বিশ্বাস যদি অখণ্ড না হতো, অন্ধ না হতো, তাদের চিন্তায় যদি প্রশ্ন করার পরিসর থাকত, তাহলে কি তাদের পক্ষে এ রকম নারকীয় কাজ সম্ভব হতো?
যদি তাদের মাথায় আসত, তারা ইসলাম ও মুসলমানের নামে এসব করছে কিন্তু এগুলোর জন্য বিশ্বজুড়ে বিপদ বাড়ছে বেশি মুসলমানদেরই, কলঙ্কিত হচ্ছে ইসলাম ধর্ম, যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যায় লঘু, তাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকের জীবন, তাহলে কি তাদের এই উন্মাদনা অব্যাহত থাকতে পারত?
যদি তাদের মাথায় এই প্রশ্ন আসত—আইএস, তালেবান কাদের হাতে, কাদের স্বার্থে তৈরি? তাদের অর্থ, অস্ত্র, সাহস কারা জোগান দেয়? যদি তারা দেখত, এসব জঙ্গি উন্মাদনায় লাভ হয় ইসরায়েল, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশের শাসকগোষ্ঠীর। যদি তারা দেখতে সক্ষম হতো, বহু দেশে এই জঙ্গি তৎপরতার অছিলায় জনগণের বিরুদ্ধে নানাবিধ নিপীড়ন হয়রানি বাড়ছে, অনেক মুনাফাখোর নির্যাতকের ক্ষমতা বাড়ছে, এর কারণে বহু নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, তা হলেও কি তারা এ রকম নরক তৈরি করতে পারত? এসব বিষয় চিন্তার ক্ষমতা থাকলে, দেখার চোখ থাকলে, সংবেদনশীল মন থাকলে কি তাদের পক্ষে ধর্মের নামে, পশ্চিমা বিরোধিতার নামে মানুষবিরোধী ভূমিকা নেওয়া বা বিশ্বের নির্যাতক, দখলদার, যুদ্ধবাজদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভব হতো? হতো না।
সমাজের মধ্যে চিন্তার নিষ্ক্রিয়তা বা ÿক্ষমতাবানদের সবকিছু মেনে নেওয়া সেটাও এই রকম অন্ধবিশ্বাস থেকেই আসে। বাংলাদেশে গত কিছুদিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে আটক করেছে সন্ত্রাস দমনের নামে। কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষ খুন করেছে হেফাজতে, ক্রসফায়ারের নামে। বিশ্বাস এতই অন্ধ যে, ক্রসফায়ারের একঘেয়ে মিথ্যা গল্পও এ রকম বিশ্বাসীর কাছে উপাদেয়। সমাজে অনেকে এগুলো বিশ্বাস করেন, শান্তিতে থাকেন। হয়তো তত দিন, যত দিন তঁার কাছের কেউ রাস্তায়, ঘরে, শিক্ষাঙ্গনে একই রকম বিপদে পতিত না হয়। কিন্তু যারা দেখতে সক্ষম ত্বকী, তনু, মিতু, সাগর-রুনি হত্যাকারীদের বাঁচানোর জন্যই রাষ্ট্রের যত চেষ্টা, আটক হাজার হাজার মানুষকে হয়রানি আর আটক-বাণিজ্যেই সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমের পরিণতি, নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা সুরক্ষিত গুলশানে দুনিয়া কাঁপানো হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রাখঢাক, তখন তাদের পক্ষে বিশ্বাস নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশে উন্নয়ন গণতন্ত্র ইত্যাদি ঘিরেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সরকারকে বিশ্বাস করতে পারলে অনেক সুখ, শান্তিতে ঘুমানো যায়। সরকার বলছে, তারা উন্নয়ন করছে বিপুল পরাক্রমে। বলছে, তারা সন্ত্রাস দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সরকার বলছে, এটাই গণতন্ত্র। পুলিশ-র্যাব নানা তথ্য দিচ্ছে তাদের সাফল্যের। সেগুলোর অনেক গোঁজামিল উপেক্ষা করে কেউ যদি পূর্ণ বিশ্বাস আনতে পারে, তাহলে তো আর যন্ত্রণা থাকে না।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের আঙিনায় ভারত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। বাংলাদেশ সরকার এতে খুবই আগ্রহী সহযোগী। ১২ জুলাই দুটি কোম্পানির প্রধান হিসেবে দুজন ভারতীয় কর্মকর্তা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি সই করলেন। পেছনে হাততালি দিতে থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।’ প্রশ্নহীন আনুগত্য যাঁদের, অন্ধবিশ্বাসী যাঁরা, তাঁরা এর ওপর ভর করেই নিশ্চিন্ত থাকেন। কিন্তু যাঁদের কাছে তথ্য আছে, ভারত তার অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কারণে এ ধরনের কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে, আইন পরিবর্তন করছে, গ্রিন ট্রাইব্যুনাল করেছে। তাদের আইন এবং বিধিনিষেধের কারণে এ ধরনের প্রকল্প ভারতে করা সম্ভব হবে না। কিংবা অবিশ্বাসীরা যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তির খোঁজখবর
নিয়ে দেখেন, ভারতেই বহু স্থানে পানি-বায়ুদূষণ হয়ে বছরে লক্ষাধিক মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। যখন বিবেচনা করেন, এই সুন্দরবন কয়েক কোটি মানুষের জীবন রক্ষার আশ্রয়, যখন বোঝেন সুই থেকে রকেট বানানো যায়, তাজমহলও মানুষ আবার বানাতে পারে, কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এই বন মানুষ আরেকটি কখনোই বানাতে পারবে না, তখন অনেক মানুষের মনে শান্তি থাকে না। এসব তথ্য, চিন্তা সরকার, কোম্পানি বা কনসালট্যান্টদের প্রতি বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়। তখনই হয় অশান্তি।
মানুষ যখন প্রশ্ন করতে থাকে, তখন অশান্তি থেকে তার সক্রিয়তা তৈরি হয়, সৃষ্টি হয়। সমষ্টির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সমাজ যখন নড়ে, তখনই এ অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা। মানুষ সাবালক হোক, অন্ধবিশ্বাস থেকে সৃজনশীলতায় তার উত্তরণ ঘটুক, প্রশ্ন করার সামর্থ্য আসুক। এতে অশান্তি আছে ঠিকই, কিন্তু মৃতের শান্তি থেকে সমাজকে জীবিতের শান্তির জায়গায় নিতে
এই সৃজনশীল অশান্তির মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]/[email protected]