সন্ত্রাস দমনে আমাদের অবস্থান

ঢাকার রাজপথে নিরাপত্তা তল্লাশি
ঢাকার রাজপথে নিরাপত্তা তল্লাশি

বাংলাদেশে উপর্যুপরি জঙ্গি হামলার ঘটনা এবং দেশের ইতিহাসে একক জঙ্গি অভিযানে সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশি নাগরিককে ঠান্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যার পর সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে জানতে পারে যে সমমনা তিন জঙ্গি সংগঠনের (জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হরকাতুল জিহাদ) নেতাদের বিচার শুরুর প্রক্রিয়া দুই বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে সরকার কিংবা সরকারি আমলাতন্ত্র। এই দোদুল্যমানতা এবং পিছুটান রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কি না, সেটি আবিষ্কার করা যায়নি মন্ত্রীদের বিভ্রান্তিমূলক কিংবা অস্বচ্ছ বক্তব্যের কারণে। একই সঙ্গে এসব ঘটনার পাশাপাশি আরও কয়েকটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দেশে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে, এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্য যা হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ। এসব ঘটনা একের পর এক সাজিয়ে দেখা যেতে পারে।
এক.
চলতি মাসে (জুলাই ২০১৬) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধ-সম্পর্কিত বার্ষিক সভা। কিন্তু গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর সভাটি বাতিল করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ, সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যরা নিরাপত্তার কারণে ঢাকায় আসতে চাইছেন না। উল্লেখ্য, এপিজি হচ্ছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে গৃহীত ও সুপারিশকৃত ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে নিয়োজিত এক বহুজাতিক সংগঠন। মোট ৪১টি দেশ ও ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ), আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ওইসিডি ও এগমন্ট গ্রুপ এই সংগঠনের সদস্য। সভাটি ছিল এপিজির ১৯তম বার্ষিক সভা, ১৮তমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিউজিল্যান্ডে। বার্ষিক সভার ভেন্যু হিসেবে নিউজিল্যান্ডের পর বাংলাদেশকে নির্বাচন করা ছিল আমাদের জন্য এক মর্যাদার বিষয়। সভাটি বাতিলের ফলে যে কেবল আমাদের হোটেল-ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য হবে বড় আঘাত—সেটিই উদ্বেগের কারণ।

 দুই.
এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য টেলিযোগাযোগ-সম্পর্কিত এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের সম্মেলনটিও বাতিল করে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাতিলকৃত এই দুই অনুষ্ঠানে প্রায় ৮০০ বিদেশি প্রতিনিধির অংশগ্রহণের কথা ছিল। অনুষ্ঠান দুটির বাইরে আরও অনেক পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে থাকতে পারে, যা হয়তো আমাদের জানা নেই।

তিন.
সিঙ্গাপুরে কর্মরত চারজন বাংলাদেশি শ্রমিককে জঙ্গি কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তার প্রমাণিত অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক এবং অন্যদের জন্য এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

এখানে উল্লেখ্য, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরের চেষ্টায় বাংলাদেশ ২০১৪ সালে এফএটিএফের ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিল। তারপর থেকে সেই অর্জন ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তত্ত্বাবধানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট এফএটিএফের সুপারিশ মোতাবেক বিএফআইইউ নামে একটা স্বাধীন ইউনিট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ২০১২ সালে। অবৈধ অর্থ ও সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের ওপর নজরদারি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এ-সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানই এই কেন্দ্রীয় ইউনিটের মূল কার্যক্রম। আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর সমন্বিত মোর্চা হচ্ছে এগমন্ট গ্রুপ। ১৪৬ সদস্যের এই দলে বাংলাদেশ প্রবেশাধিকার পায় ২০১৩ সালে।

অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে জি-৭ দেশগুলোর উদ্যোগে গঠন করা হয় আন্তরাষ্ট্রীয় মোর্চা এফএটিএফ। এটার মূল কাজ দেশে দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর এই মোর্চার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয় সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ। বর্তমানে ৩৪টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলসহ মোট ৩৬টি সদস্যপদ রয়েছে এফএটিএফের। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের উদ্দেশ্যে এটি থেকে সময়ে-সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনা কিংবা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ৪০টি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য ৯টি সুপারিশ কার্যকর আছে।

এই ৪৯টি সুপারিশের বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি দেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারে। বিভিন্ন দেশকে নিজ নিজ অবস্থানের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের সুযোগ দিয়েছে এফএটিএফ। এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি ও সদিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে এফএটিএফ দেশগুলোকে শ্রেণীকরণ করে। ফলে যেসব দেশ সুপারিশমালা বাস্তবায়নে অক্ষম কিংবা যাদের অগ্রগতি ধীর বা অনুপস্থিত অথবা যাদের অন্য দেশের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সম্পর্কিত তথ্যাদি সরবরাহ করতে অসমর্থ বা অসহযোগী বলে প্রতীয়মান হয়, সেসব দেশকে এফএটিএফের কালো তালিকাভুক্ত বলে গণ্য করা হয়।

২০১৩ সালে এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ লাভ করার পর ২০১৪ সালে এফএটিএফের ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসাটা ছিল অ্যান্টি মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধের পথে একটা প্রান্তিক সাফল্য, কারণ আমাদের আরও বহুদূর যাওয়ার কথা ছিল। এই অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে আমাদের কিছু করণীয় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেসব নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবায়নের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমাদের দেশে প্রায় সব বিষয়ে পর্যাপ্ত আইন থাকা সত্ত্বেও সেসব বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা বরাবরই উদাসীন। 

বাংলাদেশে ঢাকায় বাতিলকৃত এপিজির বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার কথা ছিল। জানা যায়, এপিজি যে মূল্যায়নের খসড়া প্রস্তুত করেছে তাতে মোট ১১টি সূচকের মধ্যে একটি মাত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুব ভালো হলেও ছয়টিতে মধ্যম এবং বাকি চারটিতে অসন্তোষজনক। এ কারণে বাংলাদেশ আবার এপিজির ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ঢুকে পড়তে পারে। ঢাকায় এপিজির বার্ষিক সভাটি করতে না পারার পেছনের কারণ এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আশঙ্কা সত্যি হলে এই পদাবনতি দেশের ভাবমূর্তির জন্য যেমন ক্ষতিকর হবে, তেমনি বিরূপ প্রভাব ফেলবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর। অনেকেরই জানা নেই যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স লেনদেন করার ব্যাপারে কয়েকটি বহুজাতিক ব্যাংক সুস্পষ্ট অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। তাদের এই অস্বস্তি যে অমূলক নয়, সেটি তারা এখন সহজেই প্রমাণ করতে পারবে জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থ সাহায্যের অভিযোগে সিঙ্গাপুরে চার বাংলাদেশির সাজার ঘটনার মাধ্যমে।

দুই বছর আগে বাংলাদেশ যখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিল, তারপর থেকে আমাদের বহু করণীয় আমরা সমাধা করতে পারিনি। যেমন—মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এককভাবে তাদের করণীয় নিখুঁতভাবে পালন করার চেষ্টা করলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। ফলে প্রতিরোধব্যবস্থা শিথিল থাকার কারণে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধের অনেকগুলো স্তরের মধ্যে একটিমাত্র ক্ষেত্রের রক্ষক হিসেবে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখতে পাই এ বিষয়ে আমাদের বহু ব্যর্থতা আছে। দুই বছর ধরে নিষিদ্ধঘোষিত তিন জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের বিচার শুরু না হওয়ার পেছনের দৃশ্যমান উদাসীনতা এই ব্যর্থতাগুলোর একটি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোনো মহলেরই কোনো অবস্থান আজ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়নি। দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলেও যদি আইন প্রয়োগে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া গ্রহণে সরকারি নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়, সেটিকে পরোক্ষ মদদ বলে ধরে নিলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ঢাকায় এপিজির বার্ষিক সভা বাতিলের ঘটনা সন্ত্রাস দমনে আমাদের ব্যর্থতাই নির্দেশ করে।

বিভিন্ন কারণে বিদেশে ভাবমূর্তির সংকট নিয়ে আমাদের নানা ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। দেশের সীমান্তের বাইরে পা দিলেই তা অনুভব করা যায়। কিন্তু আবারও ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ঢুকে পড়লে সেটি হবে দেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য অনেক বেশি ক্ষতির কারণ। ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া এপিজির বার্ষিক সভায় আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। এফএটিএফের সুপারিশগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর বোধোদয় কিংবা সক্রিয়তা নিশ্চিত করা গেলে আমরা আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। কিন্তু সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা কোনো মহল যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন আইন বাস্তবায়নের বিষয়গুলো ঝুলিয়ে রাখে কিংবা না দেখার ভান করে, তাহলে সেটা হবে মহা বিপদ।

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক  ব্যাংকার৷