মার্কিনদের সঙ্গে তাজউদ্দীনের সংলাপ

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের প্রিয় নেতা, যিনি শুধু জাতীয় নেতা নন, রাষ্ট্রনায়কের আসনে তাঁকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বসাতে পারি। তাঁর জন্মদিনে আমরা অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
তাঁর এবারের জন্মদিনটি এমন এক পটভূমিতে এল, যখন সংসদে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিতর্ক দেখা দিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও শেখ সেলিম মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের একটি মন্তব্যের (যুক্তরাষ্ট্র দখল করবে না বাংলাদেশ) প্রতিবাদ জানালেন। আর বহুদিন বাদে বিরল দৃশ্য দেখা গেল, সরকারি দল তাতে বিভক্ত হলো। অনেকেই তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করলেন। এই লেখায় আমি তাজউদ্দীন আহমদের মার্কিন সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করব। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় থাকে তখন অভ্যন্তরীণ তর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকেই। এটা ঐতিহাসিক প্রবণতা, স্বাধীনতার আগ থেকেই কমবেশি ধারাটা চলছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ একমত যে, বাইরে এখন সম্পর্কের যেমন একটা টানাপোড়েন প্রতীয়মান হয়, সেভাবে ভেতরটা নয়। শুনেছি মার্কিনরাই স্বীকার করে, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন সুউচ্চ, যা অতীতের সব সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। তাই ভাবলাম, তাজউদ্দীন-মার্কিন সংলাপের একটি স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে সাজাই আজকের অঞ্জলি।

তাজউদ্দীন আহমদ তখন অর্থ ও পাটমন্ত্রী। ওয়াশিংটন সফরকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই প্রতিশোধের জন্য নয়, কী নৃশংসতা ঘটেছিল, সেদিকে আমরা বিশ্বের নজর কাড়তে চাই, ভবিষ্যতে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট গবনের উদাহরণ দিলেন। বললেন, সে দেশে গৃহযুদ্ধে যথেষ্ট সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে। অথচ তিনি তার বিচার করেননি। সরাসরি দেশ গঠনে মন দিয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সের নামে তৈরি ওই বৈঠকের বিবরণী থেকে দেখা যায়, তাজউদ্দীন তখন শিথিলভাবে সে কথায় সায় দেন। রজার্সের বর্ণনায়, তাজউদ্দীন কিসিঞ্জারের যুক্তির শক্তি স্বীকার করেন। তিিন বলেন, ‘হ্যাঁ, কথা ঠিক যে বিচার করলেই ভবিষ্যতের কোনো নৃশংসতাকে প্রতিরোধ করা যাবে না।’ এটা ১৯৭৩ সালের ১ আগস্টের কথা। ওই বৈঠকে কিসিঞ্জার এ কথা তোলেন, ‘আমরা অভিযুক্ত হচ্ছি যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছি।’ কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘এটা অসম্ভব। আমরা বুঝতে পারি যে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজন আছে এবং বাংলাদেশে ভারতের “গঠনমূলক” ভূমিকা ওয়াশিংটনে সমাদৃত হয়ে থাকে।’ এ বিষয়ে তাজউদ্দীন কোনো মন্তব্য করেছিলেন কি না, তার কোনো উল্লেখ নেই।

চুয়াত্তরের নভেম্বরে হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকায় এলেন। ৯ নভেম্বর ১৯৭৪ ঢাকায় তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার লিখেছেন, ‘পররাষ্ট্রনীতিকে যাঁরা জোটনিরপেক্ষ দেখতে চান, তাঁরা কিসিঞ্জারের সফরের ফলাফলে সন্তুষ্ট। কারণ, এতে সব বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি টিকে থাকছে। আর কোনোভাবেই এর ফলে সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো কমতি পড়ছে না। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেও বাধা হচ্ছে না।’

গত সপ্তাহে আমি একটি ঘরোয়া বৈঠকে ছিলাম, যেখানে বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এককাট্টা যে, বর্তমান সরকারের বিদেশনীতি অসাধারণ সাফল্য ও ভারসাম্যপূর্ণ—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। সব বড় শক্তি সবাই বড় মিত্র। এখন বোস্টারের ওই বিবরণ থেকে দেখি, চুয়াত্তরেও আমাদের বিদেশনীতি সম্পর্কে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল!
বোস্টার এরপর অবশ্য লিখেছিলেন, ‘তবে ভারত ও সোভিয়েতের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা বাম ও উদারনৈতিকেরা অবশ্য মনে করেন, কিসিঞ্জারের সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ঈষৎ হলেও পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ার সংকেত দিল।’

কিসিঞ্জারের সফরের চার দিন আগে ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেছিলেন। বোস্টার লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীনকে অপসারণ কাকতালীয়ভাবে এই সফরের আগে হওয়ার কারণে সেটাকে ওই মহলটি একটা প্রমাণ হিসেবে হাজির করছে যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপযোগী করে বিদেশনীতি প্রণয়নের পথে ওই অপসারণ ছিল মুজিবের একটি বার্তা।’
২২ জানুয়ারি ১৯৭৫। মার্কিন দূতাবাসের একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ঢাকায় সে সময় মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন আরভিং চেসলো অপসারণের কারণ হিসেবে শেখ মুজিবের বিকল্প হতে ‘নিজেকে প্রদর্শন’ করাকে চিহ্নিত করেছিলেন। চেসলোর কথায়, অর্থনৈতিক নীতির প্রতি ক্রমেই সমালোচনামুখর তাজউদ্দীন সংকট উতরাতে সমাজতন্ত্রের একটা কড়া ডোজ সুপারিশ করেছিলেন।

পঁচাত্তরের মার্চে মার্কিন দূতাবাসের পূর্বাভাস ছিল, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে বাকশালের ভাইস চেয়ারম্যান বা সাধারণ সম্পাদক করবেন। কিন্তু ৬ মার্চ তাজউদ্দীন মার্কিন কূটনীতিককে একটি মন্তব্য করেছিলেন। আমি তাঁর জন্মদিনে তাঁর সেদিনের এই মূল্যায়নটিকেই বড় করে দেখি। তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘দলের ভেতরে এই সময়ে আমার পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ আছে বলে আর মনে হয় না।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, বাকশাল করলেও তা যে কার্যকর কিছু হবে না, সেটা তাঁর অনুভবে ছিল। দল খুব দুর্বল, সরকার খুব সবল। সেটা শক্তি নাকি ভঙ্গুরতার পরিচায়ক?

তাঁর জন্মদিনে এই বোধের একটা পুনর্জন্ম কামনা করি।
ওই মার্কিন কূটনীতিকের কাছে তিনি একজন রাষ্ট্রপতি মুজিবের সাফল্য কামনা করেছিলেন। একজন দূরদর্শী, প্রাজ্ঞ তাজউদ্দীন সীমারেখা টানতে ভোলেননি। বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির জন্য শুভকামনা। কিন্তু সেটা তাঁর একজন পুরোনো বন্ধু হিসেবে, একজন সক্রিয় রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে নয়। মার্কিন ওই কূটনীতিককে আরও বলেছিলেন, ‘সারা জীবন গণতন্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছি। গণতন্ত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমার পক্ষে দলের এই অবস্থা মেনে নেওয়া কঠিন।’
১৯৭৫ সালের ১১ মার্চ আরভিং চেসলো ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে এই বিবরণ দিয়ে যথার্থই লিখেছিলেন, তাঁর আসলে কিছুই করার নেই। তিনি এখন শুধু একজন অতি-বিনয়ী মানুষ হয়েই থাকতে পারেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]