জঙ্গি মৌলবাদের উত্থান: আমাদের দায়

.
.

গত জুনে প্রথম আলোয় আমি যখন সাম্প্রদায়িকতার বিপদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অসহায়ত্ব ও দেশত্যাগে বাধ্য করা, সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তাহীনতা, বিএনপির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝে হালকা করে দেখা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বেগ ও ভীতি প্রকাশ করে কলম লিখেছিলাম, তখনো ধারণা করিনি পরিস্থিতি আসলেই কতটা ভয়াবহ। ১ জুলাই গুলশানের রেস্টুরেন্টে ও তার পরে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতকে টার্গেট করে জঙ্গি হামলা আমাকে ও আমার মতো অনেককেই বুঝিয়ে দিল পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

গত এক-দেড় বছরে জঙ্গি হামলা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। প্রথমে ছিল লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যা করা। হত্যার প্যাটার্নটা একই। চাপাতির ঘায়ে নৃশংসভাবে খুন করা। অভিজিৎ থেকে শুরু করে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফয়সল আরেফিন দীপন একই ধরনের চাপাতির ঘায়ে নিহত হলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যাকারীদের অভিযোগ ছিল, তাঁরা নাস্তিক। ইসলাম ধর্মের বিধানে নাস্তিকতা অপরাধ। কিন্তু সে অপরাধের শাস্তি দেবেন আল্লাহ। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কাউকে হত্যা করতে পারে না। বরং সেটাই হবে অপরাধ।

কিন্তু কিছু ব্যক্তি অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে নাস্তিকতার অভিযোগে হত্যা করছে। সেখানে পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এমন আচরণ করছে, যাতে মনে হয় নাস্তিক বা কাফের বলে যে কাউকে যে কেউ খুন করতে পারেন। গত বছর গণজাগরণ মঞ্চকে সরাসরি নাস্তিক আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম দলের নেত্রী ও সাবেক দুবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এক নোংরা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির জন্ম দিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী নেতৃত্বের আশীর্বাদপুষ্ট নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমান যখন স্কুলের সম্মানিত প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর মতো জঘন্য অপরাধ করেন, তখন তিনি অজুহাত তুলেছিলেন, তিনি নাকি এক নাস্তিককে শাস্তি দিচ্ছেন। অপমান হওয়া শিক্ষক হিন্দুধর্মাবলম্বী। তাই নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে তাঁকে প্রহার করা, অপমানিত করা সহজ হয়েছিল। সরকার ও প্রশাসন কিন্তু এখনো নির্বিকার। কোনো প্রতিকার পাননি সেই সম্মানিত শিক্ষক। বিচারও হয়নি। এসব ঘটনাও সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিকে সরাসরি উৎসাহিত করে।

এখানে একটা তুলনা আমি উল্লেখ করতে চাই। ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাতকেরা যখন চাপাতির ঘায়ে মানুষ খুন করে, তখন তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়। আর শ্যামলকান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর সময়ও দেখলাম সেলিম ওসমানের পক্ষের লোকেরা উৎসাহভরে তালে তালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। আমরা দেখলাম, রাজনীতিতে আপাতদৃষ্টিতে দুই প্রতিপক্ষ কীভাবে মহান বাণী বা স্লোগানকে কুকর্মে ব্যবহার করতে পারে। ধর্মের মহান ধ্বনি এবং একাত্তরের মহান রণধ্বনিকে কত নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। একদল সরকারবিরোধী—জামায়াত-শিবিরের মদদপুষ্ট, যাদের সঙ্গে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে সরকারের সমর্থনপুষ্ট চরমভাবে অধঃপতিত এক গোষ্ঠী। আমি বলি না যে এরা সরাসরি জঙ্গি হামলায় জড়িত। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এবং শাসক দলের আপসকামী ভূমিকা ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও জঙ্গিদের উৎসাহিত যে করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এবার পুলিশের ভূমিকা দেখুন। শোলাকিয়ার ঘটনায় পুলিশের সাহসী ও দক্ষ ভূমিকার আমি প্রশংসা করি। কিন্তু এর আগে যখন এক এক করে লেখক, ব্লগার, প্রকাশক খুন হচ্ছিলেন, তখন পুলিশপ্রধান ব্লগারদের উপদেশ দিয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে লেখালেখি বন্ধ করতে। খালেদা জিয়া যাঁদের নাস্তিক বলছেন, পুলিশপ্রধানও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ আনছেন তাঁদের বিরুদ্ধে।

বিএনপি তো সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ। কিন্তু আওয়ামী লীগও ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ ও ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে ক্রমাগত আপস করে চলার চেষ্টা করছে। এই সবই জঙ্গি মৌলবাদকে উৎসাহিত করছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে শাসক দল পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে পারে না। শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আওয়ামী ওলামা লীগ যখন মুক্তবুদ্ধির মানুষকে কাফের বলে অথবা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে অনৈসলামিক ঘোষণা দেয়, তখন প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যে হেফাজতকে দিয়ে একসময় খালেদা জিয়া ‘ইসলামি বিপ্লব’ ও সরকার উচ্ছেদের মহাপরিকল্পনা এঁটেছিলেন, পরে দেখা গেল শাসক দলও সেই হেফাজতের সঙ্গে নানা ধরনের আপস করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা হলো প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ। এই মানসিকতা থাকলে জঙ্গি মৌলবাদকে পরাস্ত করা যাবে না। সারা দেশের মানুষ যখন শ্যামলকান্তির অপমানিত হওয়ার ঘটনায় মারাত্মক ক্ষুব্ধ, তখন আবার মাঠে দেখা গেল হেফাজতে ইসলামকে। তারা তাদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে অবস্থান নিল সাংসদ সেলিম ওসমানের পক্ষে এবং শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে। কবি ও চিন্তাবিদ আবুল মোমেন তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘আরেকটা বিষয় পরিষ্কার হলো, সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রতি যতই তোয়াজ-তোষণের নীতি অনুসরণ করুন না কেন, তারা কিন্তু ঠিকই ফিকিরে আছে যেকোনো মওকায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে।’ (প্রথম আলো, ১ জুন)।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই জায়গা দিয়ে আসি। জঙ্গিরা প্রথমে খুন করল কয়েকজন ব্লগার, লেখক ও প্রকাশককে। তারপর তাদের খুনের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘতর হতে লাগল। পুরোহিত, যাজক, ভিক্ষু, শিয়া মসজিদের মুসল্লি, সুফিবাদী মুসলিম—একে একে সবাই চাপাতির ঘায়ে অথবা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হলেন। সংগীতপ্রিয়তার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মপ্রাণ শিক্ষক নিহত হন। সমাজসেবক হোমিও চিকিৎসক নিহত হন। সবশেষে গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে জঙ্গিদের আক্রমণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন বোধ হয় সরকারের কিছুটা টনক নড়েছে। এখন উচিত সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ধর্মীয় জঙ্গিবাদকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করা। কিন্তু জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে কে?

প্রধান দায়িত্ব সরকারের। বড় দল হিসেবে বিএনপিরও দায়িত্ব আছে। কিন্তু উভয় দলই আপাত ও ক্ষণিক রাজনৈতিক ফায়দা তোলার দিকেই আগ্রহী বেশি। বিএনপি যদিও এই সুযোগে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে, তবে তারা জামায়াত প্রসঙ্গে নিশ্চুপ। জামায়াত সঙ্গে থাকা পর্যন্ত কেউ কি ধর্মীয় জঙ্গিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিএনপিকে বিশ্বাস করবে? অথচ দলটি বড়। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দলটিকে সমর্থন করে। বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক কাতারে না এলে এখনই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোর পাতায় লিখেছেন, ‘বিএনপি এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সুযোগে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়।’ মেননের ভাষায়, ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’। সেই প্রসঙ্গ টেনে সাংবাদিক এ কে এম জাকারিয়া যথার্থই লিখেছেন, ‘আসলে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার সুযোগ কেউই হারাতে চায় না।’ তিনি ঠিক একই ধরনের অভিযোগ করেছেন সরকারি দলের বিরুদ্ধে। ‘জঙ্গিদের এই জ্বালানো আগুন যেন সরকারি দল ও তাদের নেতাদের বিএনপিকে আরও একহাত নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।’

এককথায়, এমন সংকটের সময়ও এই দুই বড় পক্ষ পরস্পরের দোষারোপের রাজনীতি ছাড়তে পারল না। উভয় পক্ষেরই এই রাজনীতি অসৎ ও অর্বাচীন। বিএনপির এখন উচিত অন্য সব দাবি আপাতত সামনে না এনে জঙ্গি প্রতিরোধে এগিয়ে আসা এবং জামায়াতকে ত্যাগ করা। সরকারের উচিত গুলশান বা শোলাকিয়ার মতো ঘটনায় অযৌক্তিকভাবে বিএনপিকে দোষারোপ না করে জামায়াত বাদে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই উদ্যোগ কোনো তরফ থেকেই দেখা যাচ্ছে না। সিপিবি-বাসদ আন্তরিকভাবে চাইছে জামায়াত বাদে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বিপদ মোকাবিলা করতে। কিন্তু তাদের এই ডাকে কজনই বা সাড়া দিয়েছেন? এমন ভয়াবহ বিপদের দিনেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথাই ভাবছে। তাই এ কে এম জাকারিয়ার কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হয়, ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার সুযোগ কেউই হারাতে চায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, সবাই আলু পোড়ার সুযোগ নিলে আগুন নেভাবে কে? জনগণকে মনে হয় পুড়তেই হবে।’
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।