কোচিং-বাণিজ্যের খোলনলচে

একটি বড় অভিযোগ, শিক্ষকেরা  ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে বেশি আগ্রহী কোচিং-বাণিজ্যে। প্রশ্ন তোলা কি অসংগত যে, কেন তাঁরা এই অসাধু পথের পথিক হলেন? এই সমাজ, এই রাষ্ট্র কি শিক্ষকদের এই অনৈতিক পথে ঠেলে দেয়নি? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, কত ভাগ শিক্ষক এই অনৈতিক কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত? প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, পাবলিক পরীক্ষা, সরকারি বা যেকোনো চাকরির জন্য পরীক্ষায় অংশ নিতে আমাদের সন্তানেরা কোথায়, কার কাছে কোচিং করতে বাধ্য হয়? কোনো পরিসংখ্যান, হিসাব কি কারও কাছে আছে? আমরা কি কেউ অনুসন্ধান করে দেখেছি, এ দেশে বছরে কত হাজার কোটি টাকার কোচিং-বাণিজ্য হয়?

কবুল করছি, আমাদের শিক্ষকদের নৈতিক মান ক্রমেই নিম্নগামী, তাঁদের নিষ্ঠার অভাব রয়েছে। তাই তাঁরা ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং-বাণিজ্য করেন। হতে পারে, কিছু বিষয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষকই কোচিং করান। কিন্তু এমন অনেক শিক্ষকও আছেন, যাঁরা আদৌ কোচিং করান না। তাঁদের সংখ্যা কি একবারেই নগণ্য? এরপর যা অনুসন্ধানের বিষয়, তা হলো আমাদের সন্তানদের আমরা কোথায় কোচিং করতে পাঠাই? স্কুল, কলেজে? শিক্ষকের বাসায়? তাঁর ভাড়া করা কোনো দোকানে? কতজন সেখানে যায়? মোট কোচিং-বাণিজ্যের তা কত ভগ্নাংশ? এসব বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন।

দেখার বিষয়, বাংলাদেশে শিক্ষা-কোচিং-বাণিজ্যে লগ্নি পুঁজির আকার কেমন? বছরে এই বাণিজ্যে কত টাকা অভিভাবকদের পকেট থেকে লুট হয়। কারা এ বাণিজ্য থেকে কী পরিমাণ লাভ তোলে? অর্থ লগ্নিকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নামে-বেনামে কোচিং-বাণিজ্যে পুঁজির জোগান দেয় কি না? কোচিং-বাণিজ্য ঘিরে নোট, শিট, কম্পিউটার, ফটোকপি, কাগজের কেমন রমরমা ব্যবসা তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যোগাযোগ-পরিবহন বাবদ কত টাকা অপচয়, লুণ্ঠন হয়, তা-ও দেখতে হবে।

কোচিংয়ের মূল বাণিজ্য চলে কোথায়? কোচিং-বাণিজ্য কতটা লাভজনক আর্থিক লগ্নির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে? লাভ ছাড়া
তো পুঁজি বিনিয়োজিত হতে নারাজ। অন্তত ১০ ভাগ লাভে পুঁজি লগ্নিতে উৎসাহী হবে, ১০০ ভাগে সেসব সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করবে আর যদি লাভ হয় ৩০০ ভাগ, তবে দুনিয়ায় হেন অপকর্ম নেই, মায় যুদ্ধ পর্যন্ত, এমনকি তাতে নিজের ফাঁসির আশঙ্কা প্রবলতর হলেও পুঁজি যুদ্ধ-হাঙ্গামাই বাধাবে।

বাংলাদেশে বেশ কিছু কোচিং সেন্টার একচেটিয়া ব্যবসা করে। সারা দেশে তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে। তাদের বিশাল প্রচার নেটওয়ার্ক, নিজস্ব পত্রিকা পর্যন্ত আছে। নামকরা কোচিং সেন্টারগুলোতে কারা পড়ান? অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা? না, তাদের কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই। যাঁরা সেখানে পড়ান, তাঁরা ‘ভাইয়া ও আপা’। অতি সহজলভ্য ডিগ্রি নিয়ে বেকার যুবক-যুবতীরা শিক্ষা–বাণিজ্যে যোগ দিয়ে শহরে কোনোরকমে টিকে থাকেন কোনো কর্মের সন্ধানে। নামমাত্র ‘মজুরি’ তাঁদের দেওয়া হয়। মানবেতর জীবনযাপন করেন তাঁরা। কিন্তু নিরুপায় হয়ে তাঁরা এই কাজ করেন। তাঁদের হাতে গৎবাঁধা নোট। সেসব শিট শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে নানা কিসিমের টেস্ট নেওয়ার মচ্ছব। সে শিট শুধু মুখস্থ করতে হয়, সেখানে শেখার কিছুই নেই। অথচ দেশে নাকি চালু করা হয়েছে ‘সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা’! ‘মুখস্থকে না বলা’ নাকি তার মৌল বাণী!

অতি লাভজনক এই কোচিং-বাণিজ্যে কারা পুঁজি বিনিয়োগ করেন? শহরে-বন্দরে, গ্রামগঞ্জে যে ব্র্যান্ডেড কোচিং সেন্টারগুলো গজিয়ে উঠেছে, তারা জনগণের শিক্ষাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকেই লুণ্ঠন করে। দামি পোস্টার, বিলবোর্ড, পত্রিকার পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন, বহুতল আলিশান কোচিং সেন্টারে যে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়, তা গরিব শিক্ষকের পকেটের টাকায় আদৌ সম্ভব নয়। এ অর্থ যাঁরা বিনিয়োগ করেন, তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আর দশটা ব্যবসার মতোই তাঁরা এই কোচিং-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন শতগুণ বেশি লাভের লোভে। দেশের সর্বত্র তাঁরা গড়ে তুলেছেন তাঁদের বিশাল দালাল গোষ্ঠী। দালালদের কাজ হলো অহর্নিশ প্রচার করা যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো লেখাপড়া হয় না, লেখাপড়া হয় কেবল ব্র্যান্ডেড কোচিং সেন্টারে!

কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের আসনে যেখানে ‘ভাইয়া-আপার ছড়াছড়ি, সেখানে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং-বাণিজ্যের একতরফা অভিযোগ তোলা ঠিক নয়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এই কোচিং-বাণিজ্যের অপকর্মের সঙ্গী সরকারের অভ্যন্তরে সুবিধাভোগী আমলা-কেরানিদের একাংশ। দৈনিকের পৃষ্ঠাজুড়ে কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন। এসব বেআইনি কাজ যাদের বন্ধ করার কথা, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেসব উঁচু পদের লোকেরা চোখ বন্ধ করে থাকেন।

আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ৷