খান সারওয়ার মুরশিদ

অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন। তবে তাঁর ছাত্র হওয়ার আগে থেকেই তাঁকে চিনতাম পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক সাহিত্যসভায় যোগদানের সূত্রে। তাঁর চলাফেরা ও বাচনভঙ্গির মধ্যে তাঁর সুরুচির পরিচয় ধরা পড়ত, তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ পেত সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর স্বচ্ছ ও ঋজু ধ্যানধারণা। তখন তিনি নিউ ভ্যালুজ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ওই পত্রিকায় ঢাকার সমকালীন চিত্রকলা-সম্পর্কিত আলোচনা এ-বিষয়ে আমাদের আগ্রহী করে তুলেছিল। তিনি মুক্তচিন্তার প্রবক্তা ছিলেন—তার থেকে আমরা অনেক সাহস সঞ্চয় করতে পারতাম।
তাঁর সমাজমনস্কতা প্রথম থেকেই আমাদের চোখে পড়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক বৈষম্য তাঁকে পীড়িত করত। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন—যে-কোনো জায়গায় মানুষের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে তিনি একাত্মবোধ করতেন। তাঁর স্বভাবধর্মে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহা—তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র পরিসরে হোক কিংবা আফ্রিকায় জাতিপীড়নের ক্ষেত্রে হোক। এসব থেকে আমরা প্রেরণা লাভ করেছি।
পাকিস্তানে বিদ্যমান আঞ্চলিক বৈষম্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। এ-বিষয়ে অনেকখানি ধারণা তিনি পেয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাহচর্যে। দলীয় রাজনীতি না করলেও এ-কারণে ষাটের দশকে তিনি আওয়ামী লীগের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। তাঁর পিতা আলী আহমদ খান ও তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ দুজনেই অবশ্য আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএ ছিলেন। সারওয়ার মুরশিদের মতবিনিময় হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা অনেকেরই চোখে পড়েছিল। এই সূত্রেই তিনি সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।
দেশের স্বাধীনতালাভের পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ গ্রহণ করেছিলেন। অঁদ্রে মলরোকে যেখানে সংবর্ধনাজ্ঞাপন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রতিষ্ঠা তাঁর একটি মহৎ কাজ। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সংকীর্ণ রাজনীতির চাপ মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণ ছেড়ে তিনি চলে যান প্রথমে কূটনীতির ক্ষেত্রে, পরে আন্তর্জাতিক আমলাতন্ত্রে। এসব পরিমণ্ডলে যদিও সুনামের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন, তবু তা তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র ছিল না। শিক্ষাঙ্গনেই তিনি প্রত্যাবর্তন করেন শেষ পর্যন্ত, তবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দেশের বিচ্যুতি তাঁকে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ করে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
স্বৈরাচারের পতনের পরও দেশের অবস্থায় তিনি স্বস্তিবোধ করেননি। তাঁর কাছে গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল বহুত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতা। এসবের অভাব তাঁকে পীড়িত করে তুলেছিল। রাজনীতিক্ষেত্রে বড়ো দুই দলের বিরোধ যখন গণতন্ত্রের পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন তা নিরসনের লক্ষ্যে উদেযাগগ্রহণে তিনি অংশীদার ছিলেন। কিন্তু ক্রমশই তিনি উপলব্ধি করেন যে, যোগাযোগের যে-ভাষায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁর চারপাশ থেকে তা হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তিনি নিয়েছিলেন। তার ফলে অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেন। স্ত্রীবিয়োগ এবং নিজের শারীরিক অবস্থার কারণেও তাঁর সক্রিয়তা বাধাগ্রস্ত হয়। শেষ দিনগুলো তাঁর কাটে প্রায় গৃহবন্দির মতো।
এক বছর হয় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এখন রয়ে গেছে তাঁর অমলিন স্মৃতি এবং উজ্জ্বল রচনা। তিনি খুব বেশি লেখেননি। যা লিখেছেন তার সবই জ্ঞানের আভায়, উপলব্ধির গভীরতায়, বুদ্ধির প্রাখর্যে চিহ্নিত। এসবের মধ্য দিয়েই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে চিনবে। তবে মানুষটি যে আরো বড়ো ছিলেন, তা বুঝতে হলে তাঁর সমসাময়িকদের সাক্ষ্য মানতে হবে।
আনিসুজ্জামান: লেখক ও শিক্ষাবিদ। ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।