লড়াই-সংগ্রামে মাঠে থাকা মানুষটি

প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

আজ ৩১ জুলাই প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ৮৫ বছর পূর্ণ হলো। তিন দিন আগে ২৮ জুলাই তিনি ‘রামপাল চুক্তি ছুড়ে ফেলো, সুন্দরবন রক্ষা করো’ দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলপূর্ব সমাবেশে সহস্রাধিক মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। মিছিল উদ্বোধন করতে গিয়ে বললেন, ‘ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনতাম, জঙ্গলেই মঙ্গল। বড় হয়ে বুঝি এটা কত বড় সত্য। সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতোই আশ্রয়। এটা আমরা যদি রক্ষা করতে না পারি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ আমাদের ক্ষমা করবে না।’
১৮ বছর ধরে প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দেশের সম্পদ রক্ষায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই আন্দোলনের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। আর এই আন্দোলনের নানা বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণা, লেখালেখি, বিতর্ক; লিফলেট, বুকলেট, পোস্টার, বুলেটিন; এই আন্দোলনের নানা পর্বে মিছিল, লংমার্চ, ঘেরাও, ব্যক্তি গ্রুপ সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সভা—এসবের মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমাদের হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ আর এই দেশের মানুষকে ঘিরে আমাদের উদ্বেগ, ক্রোধ, বেদনা, আনন্দ, আশা অনেক কিছুই অভিন্ন।
প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজীবন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তাঁর দুই ভাইকে পাকিস্তানি ঘাতকেরা হত্যা করে। পিতাকেও হারান সেই সময়ে। তিনি জেলে ছিলেন। ১৯৭১ এ তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে তিনি বিরতিহীনভাবে যুক্ত থেকেছেন, আছেন এখনো।
শহীদুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ১৯৯৮ সালের শেষে। সে সময় বাংলাদেশের গ্যাস ভারতে রপ্তানির জন্য মার্কিন কোম্পানির অপতৎপরতায় যুক্ত দেশি-বিদেশি ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির যাত্রা শুরু তখনই।
তারপর অসংখ্য মিছিল, সভা-সমাবেশ, গবেষণা প্রকাশনা ছাড়াও রপ্তানির নামে পাচারের হাত থেকে দেশের গ্যাসসম্পদ রক্ষা, চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা, ভয়াবহ জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল, উন্মুক্ত খনির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দেশকে রক্ষা, সুন্দরবন রক্ষা, বিদ্যুৎ খাতের পুনর্বিন্যাস ইত্যাদির জন্য লংমার্চ-রোডমার্চ নামে অনেক কর্মসূচি হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-বিবিয়ানা (২০০২), ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দর (২০০২), ঢাকা-মোংলা (২০০৩), ঢাকা-টেংরাটিলা (২০০৫), ঢাকা-ফুলবাড়ী (২০০৬), ঢাকা-বড়পুকুরিয়া-ফুলবাড়ী (২০১০), ঢাকা-চট্টগ্রাম (২০১১), ঢাকা-সুনেত্রা (২০১১), ঢাকা-সুন্দরবন (২০১৩), ঢাকা-সুন্দরবন (২০১৬)। এসব কর্মসূচিতে পায়ে হাঁটার বড় অংশ থাকে; খাওয়া, বিশ্রাম, ঘুম এগুলোরও অনিয়ম-অনিশ্চয়তা থাকে। শহীদুল্লাহ ভাইকে এসবে কখনো ক্লান্ত দেখিনি।
জাতীয় কমিটির সঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ সরাসরি যুক্ত। শহীদুল্লাহ ভাই নিজে প্রকৌশলশাস্ত্রে শুধু পণ্ডিত নন, তিনি যে শাখায় অসাধারণ কৃতিত্ব নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেই শাখার বহু প্রজন্মের কাছে গুরু হিসেবে স্বীকৃত। পুরকৌশলী হিসেবে শাস্ত্রীয় ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা কিংবদন্তির পর্যায়ে। দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নির্মাতা তিনি।
আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে শহীদুল্লাহ ভাইয়ের প্রখর রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সমৃদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞান এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ অন্যতম অবলম্বন থেকেছে। তাঁর ধরনটিই হলো এমন যে কোনো কিছুই বিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গ্রহণ করা যাবে না, জনপ্রিয় হলেই তার পেছনে ছোটা যাবে না। প্রতিটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট তথ্য, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক কষ্টিপাথরে যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আন্দোলন তাই কখনোই অস্বচ্ছতা বা মুহূর্তের উত্তেজনা দিয়ে পরিচালিত হয়নি।
শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধু প্রকৌশলশাস্ত্রে নিজেকে সীমিত রাখেননি, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতিশাস্ত্র সম্পর্কেও তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি।
মানুষ ও সমাজকে উপলব্ধি এবং সব রকমের আধিপত্য শোষণ থেকে এই সমাজকে মুক্ত করার আগ্রহের কারণে নিজের জ্ঞানের পরিধি গভীর করতে তিনি এখনো সদা যত্নশীল। পাঠ, অভিজ্ঞতা ও মনোযোগের এই ব্যাপ্তি তাঁকে সক্ষম করে তোলে যেকোনো বিষয়কে একটি সামগ্রিকতার ভেতর উপলব্ধি করতে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বহু কর্তাব্যক্তির ভুল বা অসত্য বয়ান উন্মোচন করতে। এর সঙ্গে মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর জ্ঞানচর্চাকে ব্যক্তির চেয়ে বৃহত্তর প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে সাহায্য করেছে।
শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিধি নয়, একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে, বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করার সময় তাঁর কঠিন মনোবল, সংযম, শৃঙ্খলা ও সক্ষমতাও দেখেছি। যেকোনো স্থানে যেকোনো পরিবেশে তিনি খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, যেকোনো খাওয়া তাঁর পক্ষে হজম করা সম্ভব, যেকোনো যানবাহনে তিনি চলাফেরা করতে পারেন, পুকুর, দিঘি বা নদীতে সাঁতরে নিতে পারেন।
বিপ্লবী নেতা হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে আমরা শুনি শ্রেণিচ্যুতির কথা। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক বাম নেতার মধ্যে যা দেখিনি, তা পেয়েছি শহীদুল্লাহ ভাইয়ের মধ্যে। আর নিজে মেধা ও শ্রম দিয়ে, হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে পেশাগত কাজে যা আয় করেন তার উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষের লড়াই গড়ে তোলায়, দুস্থ মানুষের সেবায়, শিক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যয় করতে তাঁর কখনোই দ্বিধা দেখিনি।
মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসাই নিষ্ঠুর জগতের চালক লুটেরা ও সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস জোগাতে পারে। আমরা নিশ্চিত জানি, এই দেশ এখানে থাকবে না, আত্মমর্যাদা ও মালিকানার এই লড়াই আরও বহু লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজকে সামনে এগিয়ে নেবে। বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত সাম্যের জগতে মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবে। জীবন ও সম্পদের ওপর এই দেশের মানুষ পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।
শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই সমাজ নির্মাণের চিন্তা ও লড়াইয়ের অসামান্য নেতা-সংগঠক-কারিগর। ৮৫ বছর পূর্তির এই দিনে সর্বজনের পক্ষ থেকে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]