যাবজ্জীবন সাজা ৩০ বছর নাকি আমরণ জেল?

.
.

সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রবীণ অহিদুন্নেছার ভাগ্য ভালো। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত ২৬ জুন কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে তাঁকে দেখতে পান। এরপরে এক মাস না যেতেই ওয়াহিদুন্নেছা কার্যত মানবিক কারণে মুক্তি পেলেন। আপিল বিভাগ তাঁর যে যাবজ্জীবন দণ্ড ১২ আগস্ট ২০০৭ সমুন্নত রেখেছিলেন, সেটা রিভিউতে (নয় বছরের বিলম্ব মার্জনা করে) ১৮ জুলাই রদ করা হলো। কিন্তু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা মানে আমৃত্যু কারাভোগ হওয়া উচিত মর্মে কাশিমপুরে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছিলেন তার কোনো সুরাহা হলো না। এটা হওয়া দরকার। কাশিমপুরেই যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আরও ১৩ জন মহিলা আছেন, যাঁরা ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ছাড়া পাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ এই হিসাবটা করেছে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের দণ্ড খাটা ধরে নিয়ে। তবে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, ৩০ বছর সাজা খাটার পরও অনেকে জেলে থাকছেন। তার মানে ৩০ বছর হলেই আপনাআপনি মুক্তি মিলছে না।
আমাদের দেশে ইতিমধ্যে প্রায় বদ্ধমূল একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে কোনোক্রমেই আমৃত্যু জেলে থাকা বোঝায় না। ২০১৪ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের মূল রায়দানকারী বিচারক ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি ওই রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে মাওলানা সাঈদীকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। আর ওই রায়ে তিনি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে যাবজ্জীবন কারাবাস মানে সাঈদী যত দিন বাঁচবেন, তত দিন কারাগারেই থাকবেন।
১৯৬১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথম রায় দিয়েছিলেন যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে দণ্ডিত ব্যক্তির আমৃত্যু কারাবাস। অবশ্য ১৯৬১ সালের আগে ১৯৪৫ সালে পণ্ডিত কিশোরী লালের মামলায় ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল একই উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে অঙ্কের একটু জটিল হিসাব আছে বটে। সেই ষাটের দশক থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক ডজনের বেশি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় খুঁজে পাই, যেখানে আদালতকে বারবার বলতে হয়েছে যে যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাবাস। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এটা এতই যদি সহজ ব্যাপার হবে, তাহলে কেন একই প্রশ্নের ফয়সালা ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে বারবার করতে হচ্ছে। যে প্রশ্ন ১৯৪৫ সালে মীমাংসিত হয়েছে, ৬৭ বছর পরে সেই প্রশ্নে ২০১২ সালে দৈনিক দ্য হিন্দু এমনভাবে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে, যাতে মনে হবে এটা বুঝি কোনো একটি নতুন খবর।
দ্য হিন্দুতে ২৫ নভেম্বর ২০১২ ছাপা হলো: বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণান ও বিচারপতি মদন বি লকুরের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ একটি জনপ্রিয় ভ্রান্তি অপনোদন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘যাবজ্জীবন পাওয়া কয়েদি ২০ বা ১৪ বছর সাজা খাটা শেষ হলেই ভাবতে বসেন, এখন তাঁর মুক্তিলাভের অধিকার জন্মেছে। এটা তাঁদের ভুল ধারণা।’
আসলে ভারতের হাইকোর্টগুলোতে কেন বারবার এই প্রশ্ন গেছে তার একটা কারণ সম্ভবত সেখানেও সরকারের কাছেÿ ক্ষমা বা কারাদণ্ড রেয়াত বা মার্জনার যে ক্ষমতা রয়েছে, তার বৈষম্যমূলক ব্যবহার ঘটেছে।
আমাদের প্রধান বিচারপতি যেদিন কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে যান, সেদিন কয়েদিদের অনেকে তাঁকে প্রশ্ন করেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যাঁরা পান, তাঁদের কারাবাস ও কারামুক্তির হিসাব মেলাতে পারেন না তাঁরা। কাউকে দেখেন ৩০ বছরের পরেও জেলের ভাত খান, আবার কেউ তার কত আগেই বেরিয়ে যান। ঠিক একই ধরনের ঘটনার কারণেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রচুর রিট মোকদ্দমা হয়েছে। কখনো হাইকোর্ট বলেছেন, ২০ বছর খাটা শেষ, তাই বেরিয়ে যাওয়া তাঁর অধিকার। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে আসছেন এবং কখনো গ্রহণ করেছেন বলে কিছু অনুসন্ধান করে কোথাও পাইনি।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২২ বছরের মতো জেল খাটা হলেই একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি মুক্তি পান। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। সরকার দণ্ড রেয়াত বা মার্জনা না করলে কোনো অবস্থাতেই সাড়ে ২২ বছর বা ৩০ বছর সাজা খাটা শেষে কারও বেরিয়ে আসা বৈধ হতে পারে না। বর্তমানের রেওয়াজ হলো এ রকম মেয়াদ শেষে কারাগারগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। তখন সেখান থেকে অনুমোদন লাভকারীরা ছাড়া পান। এই নিয়মটা বদলানো উচিত বলে মনে করি। ভারতসহ অনেক দেশে এ জন্য নির্দিষ্ট আন্তবিভাগীয় সাজা পর্যালোচনা কমিটি আছে। তেমন উপযুক্ত কমিটি করতে হবে আমাদের।
যাবজ্জীবন দণ্ডিত ব্যক্তিরা এখন কে কীভাবে বের হচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দরকার। ১৯৮৫ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রশ্নে অথচ ভিন্ন কারণে ‘৩০ বছর’ শব্দটি সিআরপিসিতে যুক্ত হয়। এরপরে যাবজ্জীবন সাজা লাভকারীরা সাড়ে ২২ বছর বা ৩০ বছর কারাভোগ শেষে এ পর্যন্ত কতজন ছাড়া পেলেন, সেই তথ্য অবিলম্বে প্রকাশ পাওয়া উচিত।
১৯৫৫ সালের আগে ভারতের কোনো একটি নির্দিষ্ট কারাগারে ‘যাবজ্জীবন নির্বাসিত’ হয়ে দিন কাটাতেন যাবজ্জীবন দোষী সাব্যস্ত হওয়া কয়েদিরা। আমাদের দণ্ডবিধির ৫৩ ধারায় আগে ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ বা আজীবন দ্বীপান্তরের বিধান ছিল। ৫৭ ধারায় লেখা ছিল ‘শাস্তির ভগ্নাংশ গণনায়’ আজীবন ট্রান্সপোর্টেশন ১৪ বছর বলে গণ্য হবে। পরে ট্রান্সপোর্টেশন বদলে ‘লাইফ ইম্প্রিজনমেন্ট’ এবং ১৪ বছরের পরিবর্তে আশির দশকের গোড়ায় ২০ বছর এবং ১৯৮৫ সালে তা ৩০ বছর করা হয়।
এখন শাস্তির ভগ্নাংশ কথাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আইনের বইয়ের কোথাও লেখা নেই যে যাবজ্জীবন কারাবাস মানে ১৪, ২০ কি ৩০ বছর। এখানে ভগ্নাংশ কথাটির প্রয়োগ কেবল তখনই আসবে, যেখানে কাউকে আজীবন কারাবাসের সঙ্গে জরিমানাও করা হবে। যেমন অহিদুন্নেছা ২০০০ সালে ৩০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা ও অনাদায়ে ১ বছর সশ্রম দণ্ড পান। এই ১ বছর জেল দণ্ডিত ব্যক্তির অতিরিক্ত দণ্ড। তিনি টাকা না দিলে তাঁর সম্ভাব্য মুক্তির তারিখ ছিল ১৩ মে ২০৩১। কিন্তু এখানে যেহেতু ‘আজীবন কারাবাস’, আর জীবনের আয়ু নির্ণয়যোগ্য নয়, তাই ৩০ বছর নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এই জরিমানার টাকা অনাদায়ে জেলের হিসাবটা করার জন্য।
দণ্ডবিধির ৬৫ ধারার বিধানমতে, যেকোনো অঙ্কের জরিমানা দিতে কেউ ব্যর্থ হলে কোনো দণ্ডিত ব্যক্তিকে তাঁর মূল সাজার সর্বোচ্চ এক-চতুর্থাংশ সাজা দেওয়া যাবে। এর মানে টাকা না দিলে (এবং অনাদায়ে সাজার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা না থাকলে) যাবজ্জীবন শাস্তিপ্রাপ্ত বন্দীর কারাবাসের মেয়াদ সর্বোচ্চ সাত বছর ছয় মাস যুক্ত করা যাবে। কিন্তু যাঁর আজীবন কারাবাস, তিনি ‘অতিরিক্ত সাজা’ কখন খাটবেন? উপরন্তু এই সাজার মেয়াদ গণনা ‘একের পর এক’ (কনজিকিউটিভ) বলে গণ্য হবে, একত্রে (কনকারেন্ট) খাটা যাবে বলে ধরা হবে না। এসব বিবেচনায় এটা মনে হচ্ছে, যদি যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু হয়, তাহলে আইনে বা কোনো গাইডলাইনে তা স্পষ্ট করা উচিত হবে।
অবশ্য শাস্তির ভগ্নাংশ গণনার সূত্র হিসাবে ৩০ বছর নির্দিষ্ট করার সঙ্গে আমার মতে যদিও সরকারের সাজা মওকুফ বা রেয়াতের এখতিয়ার অনুশীলনের প্রশ্নটিই বড়। যেমন সরকার চাইলে মূল কারাবাস রেয়াত করে শুধু জরিমানা আদায় করে কাউকে ছেড়ে দিতে পারে। রাষ্ট্রের তরফে উত্তম বিকল্প তৈরি করা হয়েছে। তবে ৩০ বছরের বিষয়টিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। একে দণ্ডবিধির ৫৫ ধারার সঙ্গে যুক্ত করে দেখলে এর মানেটা আরও পরিষ্কার হবে। সরকার যাবজ্জীবন দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির প্রতি উদার হতে গিয়ে আবার যাতে যথেষ্ট অনুদার না হয়, সে জন্য ৫৫ ধারাটা সাজা কমানোর ক্ষেত্রে একটা বাধানিষেধ আরোপ করেছে। যেহেতু কারাবাস আমৃত্যু, তাই সরকার যেন আবার সাজা কমিয়ে ৩০, ৪০ বা ৫০ বছর নির্দিষ্ট করে না বসে, সে জন্য বিধান করা হয়েছে যে সরকার কারও সাজা কমাতে গিয়ে তার কারাবাসের মেয়াদ ২০ (ভারতে এটা ১৪) বছরের বেশি নির্ধারণ করতে পারবে না। দয়া দেখাতে গিয়ে রাষ্ট্র যাতে নির্দয় না হয় তার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ওপরের আলোচনায় এটাই পরিষ্কার যে যাবজ্জীবন কারাবাস মানে আমৃত্যু। আর সাজা কমানোর বিষয়ে সরকার যাতে তুঘলকি বা দলীয় সংকীর্ণতার পরিচয় না দিতে পারে, সে জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গাইডলাইন করে দিয়েছেন। আমাদের এ রকম কোনো গাইডলাইন নেই। ভারতের প্রতিটি রাজ্যে শাস্তি পর্যালোচনায় ছয় সদস্যের বোর্ড আছে। সেটা থাকলে ভারতীয় যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত কয়েদিদের মতো আমাদের কয়েদিরাও সেটা দেখিয়ে প্রতিকার চাইতে পারতেন।
আমাদের যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ব্যক্তির শাস্তির ভগ্নাংশ যেটা ৩০ বছর, ভারতে সেটা ২০ বছর। ২০০৪ সালে ২২ বছরের বেশি সাজা খাটা শেষে পশ্চিমবঙ্গের এক কয়েদি সুপ্রিম কোর্টে দরখাস্ত করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারই তথ্য দেয় যে লোকটি ২০ বছর ১ মাস ১৭ দিন সাজা খেটেছেন। কিন্তু সে কারণে তাঁকে ছেড়ে দিতে সরকারের কোনো দায় নেই। তাঁকে আজীবন খাটতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের অবস্থান সমুন্নত রাখেন। বিরল হলেও এ রকম উদ্যম আমাদের বিচার বিভাগেও আছে। ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জেলা জজ মো. আলী আকবর এক যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত, যিনি ৩০ বছর মেয়াদ বিবেচনায় অধিকার-বলে আগাম মুক্তি চাইছিলেন, তাঁর যুক্তি নাকচ করেন।
২০০৩ সালে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ ওই ৩০ বছর ধরে নিয়েই সিআরপিসিতে ৩৫ ক ধারা যুক্ত করে বিধান করেছেন যে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত লোকের বিচারাধীন থাকার মেয়াদ তাঁর মূল সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। এই সংশোধনী বেআইনি এবং তা সংঘাত সৃষ্টি করেছে। এটা ইঙ্গিতবহ যে আইনপ্রণেতারাও ভুল করে ধরে নিয়েছেন যে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তিরও নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। এই ভুলের ধারা আর কত দিন চলবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]