'জ', 'দ' ও 'খু'মুক্ত বাংলাদেশ চাই

সম্প্রতি সরকারের দুই প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁদের একজন বাংলাদেশকে ‘জ’মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ ‘জ’ দিয়ে অনেক কিছু হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওই নেতা বাংলাদেশকে ‘জ’মুক্ত বলতে জঙ্গিমুক্ত করার কথাই বুঝিয়েছেন। তাঁর সেই ঘোষণার সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই। জঙ্গিদের হত্যা, তথা নৃশংসতা দেশের কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। দেশের মানুষ মনেপ্রাণে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করেন। তবে তাঁরা একই সঙ্গে অপছন্দ করেন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি।
মন্ত্রী মহোদয় যে সংগঠনের জঙ্গিবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার নাম আওয়ামী যুবলীগ। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। দেশকে জঙ্গিমুক্ত করার পাশাপাশি মন্ত্রী যদি যুবলীগকে এসব থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিতেন, সেটি আরও উত্তম হতো। অনেক সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হাত ধরাধরি করে চলে। তাই যুদ্ধ জারি রাখতে হবে দুটোর বিরুদ্ধেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আরেক ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কীর্তির কথাও সামনে চলে আসে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের নেতারা যখন দেশবাসীর প্রতি মাসব্যাপী কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ১ আগস্ট সেটি পালন করল হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সেখানে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হলেন সংগঠনের নেতা ও মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মো. খালিদ সাইফুল্লাহ। আহত ১০ জন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল সাইফুল্লাহ একা নন, গত সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন ৫৫ জন। এই সংখ্যা জঙ্গিদের হাতে গত তিন বছরে নিহত ব্যক্তির সংখ্যার চেয়ে কম নয়।
দ্বিতীয় মন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতির ‘দ’ও তাঁকে স্পর্শ করেনি। খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু মন্ত্রীর এই ঘোষণার চেয়েও বেশি জরুরি ছিল মন্ত্রী হওয়ার আগে ও পরে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের হিসাবটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া সেই কাজ কেউ করেননি।
যে মন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতির ‘দ’ও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, তার মাধ্যমে তিনি নিজেকে সৎ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সততা প্রশ্নহীন, না প্রশ্নবিদ্ধ, সেই বিতর্কে যাব না। তিনি একজন জনপ্রতিনিধি ও সরকারের মন্ত্রীও। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি তাঁকে কতটা স্পর্শ করেছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকার নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত বলে দাবি করতে পারছে কি না?
রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত সততার মূল্য আছে। কিন্তু কোনো সরকার যৌথ সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে ব্যক্তিগত সততা খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে না। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির ঘোরতর বিরোধীরাও স্বীকার করবেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সৎ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ব্যক্তিগত সততার প্রভাব রাজনীতি ও সরকারে রাখতে পারেননি। তিনিই বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতিটা চালু করে রাজনীতিকে ‘কঠিন’ করে তুলেছিলেন।
তাই দুই মন্ত্রীর ‘জ’ ও ‘দ’মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেশবাসীর মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। ওই মন্ত্রীদ্বয় যদি ‘দ’ ও‘ জ’মুক্ত বাংলাদেশ করার পাশাপাশি ‘স’মুক্ত যুবলীগ ও ‘খ’ বা ‘খু’মুক্ত ছাত্রলীগ গড়ার ঘোষণা দিতেন, জনগণ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারত। দেশকে জঙ্গিমুক্ত করা এই মুহূর্তের জরুরি কাজ। তবে ছাত্রলীগকে ‘খুনি’মুক্ত রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা মো. খালিদ সাইফুল্লাহকে কোনো জঙ্গি হত্যা করেনি। কিংবা মৌলবাদী ছাত্রশিবিরের হাতেও তাঁকে প্রাণ দিতে হয়নি। এখানে খুনের শিকার ও খুনের হোতা উভয়ই ছাত্রলীগের।
সরকারের মন্ত্রীরা বিরামহীনভাবে বাংলাদেশকে ‘জ’ বা জঙ্গিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। তাঁরা তরুণ প্রজন্মকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলেছেন। কিন্তু এই তরুণেরা ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পাশাপাশি যখন মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরি করেছিল, সেটি কেন এবং কাদের কারণে স্তিমিত হয়ে গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানাও জরুরি। সেদিনের গণজাগরণ মঞ্চকে স্বমহিমায় জাগ্রত রাখা গেলে হয়তো জঙ্গিবাদের পুঁচকে সন্ত্রাসীরা দানবে পরিণত হতে পারত না।