হিরোশিমায় বারাক ওবামা

হিরোশিমার শহী​দদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য
হিরোশিমার শহী​দদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য

মাত্র প্রায় দুই মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হিরোশিমা সফরকে কেন্দ্র করে জাপানজুড়ে যে আলোড়ন দেখা দিয়েছিল, তার অনেকটাই এখন যেন চুপসে যাওয়া এক বেলুনের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টকে হিরোশিমায় নিয়ে যেতে পারার সাফল্য জাপানের প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও এর বাইরে অন্য কোনো প্রাপ্তি জাপানের জুটেছে বলে এখন আর মনে হয় না। যদিও হিরোশিমায় দেওয়া ওবামার ভাষণকে ঘিরে শুরুতে অনেকের মনে এ রকম আশা দেখা দিয়েছিল যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের হিরোশিমা সফরের পাশাপাশি সেখানে দেওয়া তাঁর চটকদার ভাষণ হয়তো রাজনীতিবিদদের মধ্যে নতুন এক সচেতনতা তৈরি করে নেওয়ায় সহায়ক হবে। তবে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, সেই ভাষণ সত্যিকার অর্থে যে ছিল সুন্দর শব্দাবলির মোড়কে বেঁধে নেওয়া অর্থহীন এক বক্তব্য, জাপানের অনেকেই এখন দেরিতে হলেও তা অনুধাবন করতে পারছেন। সেই দলে সংশয়বাদীরাই কেবল অন্তর্ভুক্ত নেই, এমনকি শুরুতে ভাষণের প্রশংসায় যাঁরা পঞ্চমুখ ছিলেন, তাঁরাও এখন এর অর্থহীনতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।
সে রকম এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আণবিক বোমার শিকার হওয়া ও জাপানিদের বিভিন্ন সংগঠনের দুটি সম্মিলিত ফেডারেশনের একটির মহাসচিব তেরুমি তানাকা। বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৮৪ বছর বয়সী এই বর্ষীয়ান সমাজকর্মী, হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে ওবামা যখন তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণ দেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একজন দোভাষী তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকলেও ভাষণের জাপানি অনুবাদের কোনো কপি সেদিন বিতরণ করা হয়নি। ফলে দোভাষীর আংশিক অনুবাদে ভাষণকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে সেদিন তাঁর মনে হয়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভাষণের প্রশংসা করে অনুষ্ঠানের ঠিক পরপর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। তবে এখন তিনি বলছেন, ত্বরিত সেই সিদ্ধান্তের জন্য তিনি অনুতপ্ত। কেননা, এক দিন পর ভাষণের সম্পূর্ণ জাপানি অনুবাদ সংবাদপত্রে পাঠ করার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মধুর ভাষা ব্যবহার করে অনেক কিছু বলে গেলেও এর আড়ালে আরও অনেক সত্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই চেপে গেছেন।
কিছুদিন আগে জাপানের প্রভাবশালী একটি জাতীয় দৈনিক মায়নিচি শিম্বুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তেরুমি তানাকা বলেছেন, ভাষণের যে অংশটি পাঠ করার পর গভীর অনুতপ্ত তিনি হয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে সেই বর্ণনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিরোশিমার মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন বলেছিলেন, ‘সত্তর বছর আগে মেঘমুক্ত পরিষ্কার এক সকালে মৃত্যু এখানে আকাশ থেকে নেমে আসে এবং পৃথিবী বদলে যায়।’ তিনি জানিয়েছেন যে সেই অভিব্যক্তি তাঁকে কেবল অবাক করেই দেয়নি, বরং গভীর ক্ষোভও তাঁর মনে সেটা এনে দিয়েছিল, যা থেকে ভাষণের প্রশংসা করার জন্য নিজেকে তিনি দায়ী করতে শুরু করেন। মৃত্যু সেদিন আকাশ থেকে নেমে আসেনি, বরং কারও ইচ্ছায় সেই মৃত্যুকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। মৃত্যুর সেই পরিস্থিতি যে তারাই তৈরি করে নিয়েছিল, সেই সত্যকে অস্বীকার করা হলে হিরোশিমার বাস্তবতাকেই অস্বীকার করা হয় বলে তানাকা মনে করেন।
হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার ৭১তম বার্ষিকীতে তেরুমি তানাকার মতো অনেককেই আশাহত হওয়ার বেদনায় ভুগতে হচ্ছে। ইতিহাসের দিকে সরাসরি দৃষ্টিপাত না করে ইতিহাসের সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে আন্তরিকতার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া আসলেই যে কষ্টকর, এদের সেই আশাহত হওয়ার বেদনা সেই বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। তবে তারপরও জাপানে অনেকেই মনে করছেন, বারাক ওবামার হিরোশিমায় পদার্পণ অন্তত বরফ গলার ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দায়বদ্ধতার বিষয়টি মেনে নেবেন।
মার্কিন প্রশাসন সেই সময়ে কিন্তু হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আণবিক বোমা হামলার ধ্বংসলীলা চালিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি; সেই সঙ্গে জাপানের মানুষ যাতে সেই বর্বরতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সক্ষম না হয়, সে জন্য কঠোর সেন্সরের ব্যবস্থাও বলবৎ করেছিল। সেই সেন্সরের আওতায় কেবল সংবাদ প্রচারই নিষিদ্ধ করা হয়নি, এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যকর্মেও যাতে নিজেদের বর্বরতার কোনো রকম বর্ণনা ফুটে উঠতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও তারা সেদিন নিয়েছিল। ফলে হিরোশিমার মর্মান্তিক গল্প-উপন্যাস কিংবা কবিতার মধ্য দিয়ে লিপিবদ্ধ করতে যাঁরা সেদিন প্রয়াসী হয়েছিলেন, সেটা তাঁদের করতে হয়েছিল খুবই গোপনীয়তার সঙ্গে।
তবে সৌভাগ্যের বিষয় যে, সে রকম সৃজনশীল মানুষের ঘাটতি হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে কখনো দেখা যায়নি। গোপনীয়তা বজায় রেখেই তাঁরা তা করে গেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন পাশবিকতার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। হিরোশিমার সে রকম এক পূজনীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন তানকা কবি শিনোয়ে শোদা। হিরোশিমা জেলার এতাজিমায় ১৯১০ সালে এই মহিলা কবির জন্ম এবং ১০ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে হিরোশিমা শহরে চলে এসে সেখানে তিনি বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৩০-এর দশকে তাঁর কিছু কবিতা বিভিন্ন সাময়িকীতে ছাপা হলেও পুস্তক আকারে সেগুলো কখনোই প্রকাশিত হয়নি।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মেঘমুক্ত পরিষ্কার সকালে তিনি অবস্থান করছিলেন এপিসেন্টার বা বোমা যেখানে বিস্ফোরিত হয় তার থেকে মাত্র প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। ফলে সেই বিস্ফোরণের ভয়াবহতাই কেবল তিনি প্রত্যক্ষ করেননি, হয়েছিলেন এর শিকারও। মর্মান্তিক সেই সব দৃশ্য তাঁর কাব্যিক অনুভূতিকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে কবিতায় সেগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করলেও সেন্সরের করালগ্রাসে সেসব ছাপার কোনো ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। সেই অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর পরিচিত কয়েকজন হাতে লিখে নিয়ে সেই সব কবিতার একটি সংকলন গোপনে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১০০টি তানকা কবিতার ‘সাঙ্গে’ বা ফুলের মতো ঝরে পড়া নামের সেই সংকলনের ১৫০টি কপি সেই প্রক্রিয়ায় হাতে লিখে নিয়ে তৈরি করা হয়, শোদা নিজে যেগুলো আণবিক বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন।
তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসা থেকে কবি নিজে একসময় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে ৫৫ বছর বয়সে যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর সেই হাতে লিখে প্রস্তুত করা সংকলনের একটিমাত্র কপি তখন এক আত্মীয়ের বাড়িতে সংরক্ষিত ছিল। হিরোশিমার এক বৌদ্ধমন্দিরে কিছুদিন আগে এর আরেকটি কপির সন্ধান পাওয়া যায়, গত মাসের শেষ দিকে যেটা হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য দান করা হয়েছে। জাপানের এই আণবিক বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত মহিলা কবির খুব বেশি রচনা নেই। তবে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুচ্ছ অবশ্যই হচ্ছে হিরোশিমার সেদিনের করুণ পরিণতির মর্মস্পর্শী বর্ণনা। সে রকম একটি তানকা কবিতা লিপিবদ্ধ করা আছে আণবিক বোমা হামলায় নিহত প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক ও ছাত্রদের স্মরণে বসানো ভাস্কর্যের স্তম্ভে। হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘরের অল্প দূরে বসানো সেই ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ তানকা কবিতায় বলা হয়েছে:
ভারী সেই সব হার অবশ্যই শিক্ষকের
যার চারদিক ঘিরে আছে
ক্ষুদ্র সব মাথার খুলি
হিরোশিমায় স্বল্পকালীন অবস্থানের সময় শান্তি স্মৃতি জাদুঘরে ঝটিকা পদার্পণের বাইরে সেই ভাস্কর্য দেখার সুযোগ বারাক ওবামার অবশ্যই হয়নি। ফলে আকাশ থেকে মৃত্যুর ঝরে পড়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতাকে ঢেকে রাখার অভিব্যক্তি খুব সহজেই সেদিন তিনি উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।