যাঁর প্রতিটি রক্তকণায় বাংলাদেশ

কাজুকো ইয়ামাতসু ভূঁইয়া
কাজুকো ইয়ামাতসু ভূঁইয়া

‘আমি ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে আসি। তারপর থেকে এ দেশেই আছি। সব সময় মনে হয়, এ দেশ আমার। মাঝেমধ্যে মা-বাবাকে দেখতে জাপানে গিয়েছি। কখনো মনে হয়নি আমি জাপানে ফিরে যাব। গুলশানে যা ঘটেছে, তার জন্য আমি ব্যথিত, শোকাহত বাংলাদেশের মানুষের মতোই। কিন্তু এটি অস্বাভাবিক, এ দেশের মানুষ এ রকম করতে পারে না। জাপান-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব বহুকালের, বহুকালই তা থাকবে।’
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় নৃশংস হামলার প্রতিবাদে শহীদ মিনার ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের শোক সমাবেশে এসব কথা বলছিলেন বাংলাদেশে বসবাসরত এক জাপানি নারী, যাঁর নাম কাজুকো ইয়ামাতসু ভূঁইয়া। কাজুকো যখন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন, তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় (গোর্কি) আঘাত হানে। লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। সে সময় কাজুকো পূর্ব পাকিস্তানের একজনকে খুঁজছিলেন, খুঁজে পেলেন জাপানে পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়াকে। মমতাজ ভূঁইয়া তখন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচারের ছাত্র। কাজুকো একদল জাপানি ছাত্রছাত্রীকে সংগঠিত করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে মমতাজ ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্কও গড়ে ওঠে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মমতাজ ভূঁইয়া পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ত্যাগ করে বাংলাদেশ ছাত্র সংস্থা গড়ে তোলেন। কাজুকো আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন-সহযোগিতা করার জন্য। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা কয়েক গুণ বেড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়। মমতাজ ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর প্রেম বাংলাদেশ-প্রেমে পরিণত হয়। তারপর ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই বছরেরই আগস্ট মাসে বাংলাদেশে চলে আসেন। কাজুকো সেই থেকে বাংলা ভাষা শিখে জাপানি ভাষার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কালক্রমে স্কুলটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বামীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মানুষকেও তিনি আপন করে নেন। নানা ধরনের সেবামূলক কাজে তিনি অংশ নেন।
গুলশানের ওই নৃশংস ঘটনায় কোথায় প্রতিবাদ হচ্ছে, কোথায় শোক পালন হচ্ছে, তা তিনি জানতে চান। আমি বিভিন্ন কর্মসূচি ও সেগুলোর সময়, স্থান সম্পর্কে তাঁকে জানাই। তিনি প্রথমে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মোমবাতি প্রজ্বালনে অংশ নেন এবং পরদিন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত থেকে বক্তৃতাও করেন। বক্তৃতার সারাংশ প্রথমেই বলা হয়েছে। তিনি বারবার বলছিলেন, জাপানবাসীকে জানানো দরকার যে বাংলাদেশের মানুষ কী রকমভাবে এই বর্বরতাকে ঘৃণা জানাচ্ছে। দুই দেশের অনন্তকালের বন্ধুত্ব রক্ষা করা দরকার। তাঁর কথায় মনে হয়েছে, তাঁর জন্মভূমির চেয়ে বাংলাদেশ তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেতে তিনি জাপানি ভাষায় এ দেশের জনগণের মানসিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন, জানিয়েছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ঘৃণা, প্রতিবাদ ও ধিক্কারের কথা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্নতার সময় বিদেশি অনেক মানুষ আমাদের দেশে ছুটে এসেছেন সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। স্বাধীনতার আগে থেকেই বিদেশিদের এসব অবদানের কথা আমরা জানি। এ দেশের প্রসেনিয়াম থিয়েটার যাঁর হাতে শুরু হয়েছিল, তিনিও ছিলেন একজন বিদেশি, রুশ দেশের মানুষ। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানের কথাও আমরা জানি। কিন্তু একেবারেই প্রচারবিমুখ একজন মানুষ কাজুকোর বাংলাদেশকে ভালোবাসার কথা আমি জানি না। কেমন করে তিনি ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়েছিলেন, শরণার্থী শিবিরগুলোর হতভাগ্য মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, সেসব আমাদের জানা হয়নি।
তাঁর হৃদয়ে কেমন করে বাংলাদেশ জায়গা পেয়েছিল, তাঁর প্রতিটি রক্তকণিকায় দিনে দিনে বাংলাদেশ কেমন করে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, তার ইতিহাসটাও অজানা রয়ে গেছে। মাত্র কয়েক দিন আগে আবুধাবিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে। তিনি আর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারলেন না। কী অপার আনন্দ নিয়ে ৪৩ বছর আগে তিনি এসেছিলেন প্রিয়তম বাংলাদেশে; আর কী দুর্ভাগ্য, কফিনে মোড়ানো তাঁর দেহটি ফিরল তাঁর সব সময়ের গন্তব্য বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ হারাল দেশপ্রেমী এক জাপানি নাগরিককে, যিনি নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিকই ভাবতেন এবং তাঁর সবটুকু নাগরিক দায় তিনি পালন করেছেন।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।