কেন জলাবদ্ধতা, কেন বন্যা

নদীমাতৃক দেশের মানুষকে নদীর কথা সব সময় ভাবতে হয়। জাতির উন্নতির ব্যাপারে বস্তুগত ও ভাবগত প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে নদীর প্রভাব রয়েছে। নদ-নদী যখন পাহাড়ে থাকে, তখন তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রচুর নুড়ি ও পাথর। কিন্তু যখন সমতলে নেমে আসে, তখন পলি ও নুড়িগুলো ঝেড়ে ফেলে দেয়। ফলে তারা অনেকগুলো শাখা নদ-নদীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং গড়ে ওঠে ফুলে ও ফসলে ভরা ব–দ্বীপ অঞ্চল।
আমাদের নদ-নদীগুলো যে পার্বত্য এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তার অরণ্যকে ন্যাড়া করে চা-বাগানে পরিণত করে, ধসে যাওয়ার ব্যবস্থা; পানির উত্তরে পুনঃসঞ্চালিত ও সারা বছর পানি সরবরাহের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করার কারণে ব্রিটিশ আমলে শুরু হয় ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার মতো নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হওয়ার পালা। যে অনুপাতে ভরাট হতে থাকে, ঠিক সেই অনুপাতে দুকূল ভাঙতে থাকে। ফলে ঐতিহাসিক চিলমারী নদীবন্দরের মতো অনেক কালের সাক্ষী মুছে যায়।
গত ১০০ বছরে ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা কমেছে, গ্রামগঞ্জ খেয়ে প্রস্থে সে নদ বেড়েছে ১০ গুণ। একই অবস্থা তিস্তারও। একসময় বিখ্যাত তিস্তা সেতুর তল দিয়ে জাহাজ চলত, এখন মাঝারি সাইজের নৌকাও চলে না। ফলে চলতি বন্যার মতো স্বাভাবিক বর্ষা ঋতুতেই চতুর্দিকে বান ডেকে যায়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গভীরতা অটুট রাখতে ভীম একাদশীর দিন নদ-নদীর আস্তর পলিমুক্ত করতেন, যাতে নদ-নদীতে পানি আটকে অপ্রত্যাশিত বান না ডাকে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কাবেরী ব–দ্বীপের ব্যবহার শুরু করলেও তলদেশের উত্থান বা চর জাগাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ২৫ বছরের চেষ্টায় অবশেষে দেশজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যার আর্থার কটন বৃহত্তর বাঁধটি নবায়ন করতে সক্ষম হন। ১৮৭৪ সালে তিনি লেখেন, ‘ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন দেশজ কাজ রয়েছে...। এসব কাজ হলো স্থানীয় কাজ, যা দক্ষতা ও প্রকৌশল মেধা দুটোই প্রদর্শন করত। তাদের এই আকর্ষণীয় বস্তুগত উৎকর্ষের প্রতি অবজ্ঞার কারণে তারা সঠিক অর্থেই আমাদের ঘৃণার চোখে দেখত।’
অর্থাৎ স্বাভাবিক বর্ষায় যে বন্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা আসলে নদ-নদীর মধ্যকার জলাবদ্ধতা বা প্রাকৃতিক জলাবদ্ধতা। অন্যদিকে বাঁধ ভেঙে ও স্লুইসগেটের কপাট নষ্ট থাকায় মূল ভূখণ্ডে পানি ঢুকে ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী স্থাপত্যের কারণে আটকে গিয়ে কৃত্রিম জলাবদ্ধতার কারণেও বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

২.
যুগ যুগ ধরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ ছোট ছোট অস্থায়ী জলাধার ও বাঁধ নির্মাণ করে আসছে। এগুলোর উচ্চতা হিসাব কষে এমন রাখা হতো, যাতে বর্ষার প্লাবনে এগুলো ডুবে যায় এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে নষ্ট না করে। এমনকি প্রয়োজনমতো শুকনো মৌসুমে অভিজ্ঞতা ও আলোচনার ভিত্তিতে এই বাঁধগুলো প্রয়োজনীয় স্থানে কেটে দেওয়া হতো। যাতে মাছের যাতায়াতের পথ খোলা থাকে ও নৌপরিবহন বাধাগ্রস্ত না হয়। কিন্তু বিডব্লিউডিবি অনেক ক্ষেত্রেই এই বাঁধগুলো প্রতিস্থাপিত করেছে অপরিকল্পিত স্থায়ী বাঁধ দিয়ে। এর ফল ভোগ করছে বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহের মানুষ।
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার বেতখাওয়া ও পেদীখাওয়া বিলের প্রবাহের ওপর মাটিকাটা নামক স্থানে কংক্রিটের দোকানপাট স্থাপন করে, মণ্ডলপাড়ার বিলের প্রবাহপথ সেতুতে মাছ চাষের নামে, পানাতিপাড়া ও শান্তিনগরের বিলের প্রবাহ দুটি সেতুর একটিতে বাড়ি উঠিয়ে, হাউসের ডেরা ও সবুজপাড়ার বিলের চারটি সেতুর তিনটিতে বাড়ি নির্মাণ করে ও পাত্রখাতার ভোলার ছড়ার প্রবাহপথে বাড়ি তুলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে নদ-নদীর সঙ্গে পানি কমা ও বাড়ার যে সম্পর্ক ছিল, তা ধ্বংস করা হয়েছে। নদ-নদীর পানি কমলেও মূল ভূখণ্ড থেকে পানি হ্রাসের হার কম। অর্থাৎকৃত্রিম জলাবদ্ধতা বন্যায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে পাউবো বাঁধ থাকার কারণে মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ভিটা উঁচু করার কথা ভুলেই গেছে, ফলে হঠাৎ বাঁধ ছিঁড়ে যাওয়ায় অকূলপাথারে পড়েছে।

৩.
বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ এ দেশের নদ-নদীগুলোর ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন। বন্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নদীশাসন ও বাঁধ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল, বাঁধ সাময়িকভাবে বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু বিপরীত দিক থেকে নদীর তলদেশ পলি পড়ে উঁচু হয়ে গেলে অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে খারাপ হতে পারে। তাঁর পরামর্শ ছিল, নদীতীরবর্তী অধিবাসীদের প্রতিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া উচিত এবং বসবাসের ঘর উঁচু করে নির্মাণ করা উচিত।
এবং শত শত বছর ধরে তা-ই হয়ে আসছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের ভূত আমাদের সেই সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছে।
বলা হয়, বুর্জোয়ারা নদীকে জয় করেছে আর এখানে নদ-নদীই আমাদের জয় করেছে। এই নদ-নদীই গড়ে তুলেছে আমাদের ইতিহাস, শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধও। মিসরের পিরামিড দেখে বিস্ময়াভূত প্রত্যেক লোকই জানতে চায়, আদিম মিসরবাসী যন্ত্রপাতি ছাড়াই কেমন করে এটা করতে পারল? মিসরীয়রা উত্তর দিত: পিরামিড তৈরি করতে যা লাগে, তা আমাদের ছিল। সেগুলো হচ্ছে ধৈর্য, দক্ষতা ও সাংগঠনিক শক্তি। তখন পরের প্রশ্ন থাকে: মিসরবাসী তা কোথা থেকে পেয়েছিল? উত্তর: নীল নদ।
ঠিক তেমনি, নিরস্ত্র একটি জাতি কোথা থেকে এত সাহস ও কৌশল পেল যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটি বাহিনী সেরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও পরাজিত হলো? উত্তর: এই পদ্মা এই মেঘনা এই হাজার নদীর অববাহিকায়। এই হাজার নদীর অববাহিকায় আবার মানুষ হওয়া জরুরি।
নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।