আসাম ভূমিকম্প এবং বাংলাদেশের প্রস্তুতি

১৮৯৭ সালে আসামে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত জনপদ
১৮৯৭ সালে আসামে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত জনপদ

গত বুধবার ছিল ১২ জুন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে ১৮৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ জুন মনে করিয়ে দেয় আসামের ভূমিকম্পটির কথা। দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক নামে সর্বাধিক পরিচিত ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭ (মোমেন্ট স্কেলে ৮ দশমিক ১) এবং ঘটেছিল বিকেল পাঁচটা ১১ মিনিটে। উৎসস্থল ছিল ৩২ কিলোমিটার (কিলোমিটার) মাটির গভীরে এবং ২৬-ডিগ্রি (উত্তর) ও ৯১ ডিগ্রি (পূর্ব) অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে। ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল ঢাকা থেকে কম-বেশি ২৫০ কিলোমিটার, সিলেট থেকে ১৫০ কিলোমিটার এবং ভারত-বাংলা বর্ডার থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং আজকের বাংলাদেশের সীমানায় থাকা ইটের তৈরি রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি, মন্দির, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা; যেমন জজ, কমিশনার, সিভিল সার্জন, কালেক্টরদের সরকারি বাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রেললাইন বেঁকে যাওয়া এবং ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে এক হাজার ৫৪২ জন লোক মারা যায়, যার মধ্যে দুজন বিদেশিসহ পাঁচজন ঢাকায়।

আজ ভূমিকম্পটির বয়স ১১৬ বছর। বয়স এভাবে হিসাবে রাখার কারণ ভূতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য, টেকটনিকের ইতিহাস এবং ভূমিকম্প ঘটা—এই তিনের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের মতো একটি সম্পর্ক থাকার কারণে ভূমিকম্প একবার যেখানে ঘটে, সেখানে শত বছর পর আবারও একই মাত্রায় ঘটতে পারে। ঢাকায় কম্পনের তীব্রতা ছিল মডিফায়েড মার্সিলি ইনটেনসিটি (এমএমআই) স্কেলে রোমান ৮-এর অধিক। ৮-এর অধিক স্কেল এমএমআইয়ের সর্বমোট ১২টি স্কেলের ওপরের দিকে এবং তা প্রায় ৩০০ সেন্টিমিটার/সেকেন্ড/সেকেন্ড (গ্যাল) ত্বরণের সমতুল্য। অর্থাৎ, ঢাকা শহরে ভবন যেন কমপক্ষে এমএমআই স্কেলের অন্তত ৮ তীব্রতার ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে, এমন করে ডিজাইন হওয়া দরকার।

ভূমিকম্পের বিষয়ে সচেতনতার বড্ড অভাব বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সীমানায় বড় মাপের কিছু না ঘটলে আমরা যে নড়েচড়ে বসি না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ সাভার ট্র্যাজেডি। রানা প্লাজার ঘটনার পর তিন শতাধিক ভবনের দুর্বলতা পরীক্ষা করানোর জন্য ভবনের মালিকেরা বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের দ্বারস্থ হয়েছেন। আরেকটি উদাহরণ ছিল বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগার ঘটনা। আগুন লাগার পরপরই ঢাকা শহরের কোথাও না কোথাও আগুন নেভানোর মহড়া বা ড্রিল হচ্ছিল প্রায় প্রতিদিন। ফায়ার ড্রিল করার অনুপ্রেরণা পেতে বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগতে হবে কেন? আগুন নেভানোর ড্রিল তো একটি রুটিন কাজ।

মূলত তিনটি বিষয় ঢাকা শহরকে অত্যধিক বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে, যদি এমএমআই স্কেলে ৮ বা ততোধিক তীব্রতার কম্পন হয়। দুটি ভবনসংক্রান্ত এবং একটি বাসাবাড়ির গ্যাসের চুলা। ঢাকা শহরে, বিশেষ করে আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলার কার পার্কিংয়ের তলাটি শুধু বিম-কলামের ওপর নির্মিত। কার পার্কিংয়ের তলাটির ঠিক ওপরের বাসযোগ্য তলাটিতে বিম-কলাম কাঠামোর মধ্যে ইটের দেয়ালও থাকে। এ জন্য কার পার্কিংয়ের তলাটি তার ওপরের তলাটির চেয়ে পার্শ্বশক্তির বিচারে দুর্বল, যাকে প্রকৌশল ভাষায় সফট স্টোরি বলে। উপরন্তু কার পার্কিংয়ের তলাটি সর্বনিম্ন তলা হওয়ায় ভূমিকম্পের মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি পার্শ্বশক্তি, বিশেষ করে কর্তনীয় ও বক্রনীয় পীড়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই পীড়নদ্বয়ের প্রভাব একটি ভবনের ওপর থেকে যতই নিচের দিকে নামতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটা ভূমিকম্পের ফলে নিচের এই দুর্বল তলাটি বিধ্বস্ত হয়ে অগণিত ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে নির্মিত হওয়া এমন ভবনগুলোর কার পার্কিংয়ের তলাটিকে শক্তিশালী করা দরকার, যার প্রকৌশল নাম রেট্রোফিটিং। কলামকে আরসি (রিইনফোর্সড কনক্রিট) জ্যাকেটিং করে এবং দুই কলামের মাঝে ব্রেসিং, সিয়ারওয়াল বা উইংওয়াল নির্মাণ করে দুর্বল কার পার্কিংয়ের তলাটিকে শক্তিশালী বা রেট্রোফিটিং করা যায়। রেট্রোফিটিং করার কাজ সহজ নয় এবং কিছুটা ব্যয়বহুল। তাই ভবনের নকশা ও ডিজাইন করার সময় কার পার্কিংয়ের তলাটিকে পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন করে ডিজাইন করা এবং সে অনুযায়ী নির্মাণ করা দরকার। কার পার্কিংয়ের তলাটিতে বিম-কলামের সঙ্গে আরসি ব্রেসিং বা সিয়ারওয়াল বা উইংওয়াল থাকতে হবে।

ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণে আরেকটি আত্মাহুতিমূলক কাজ হচ্ছে আরসি ফ্লাটপ্লেট (পুরু স্ল্যাব) দ্বারা ভবন নির্মাণ। যদিও নির্মাতা ও ক্রেতা উভয়ের কাছে এমন ভবন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জনপ্রিয়তার কারণ বিম না থাকাতে (ক) ফ্লাটপ্লেট গুড লুকিং, (খ) অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে থাকা কক্ষগুলোর বিন্যাস বা পুনর্বিন্যাস সহজ এবং (গ) নির্মাণকাজ সহজ ও সময় লাগে কম। কিন্তু যেকোনো উচ্চতার ভবন ফ্লাটপ্লেট দ্বারা নির্মিত হলে তা ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে যত কম উচ্চতার ভবন, তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তার কারণ, ভবনের উচ্চতার সঙ্গে কলামের মাপ বাড়লেও ফ্লাটপ্লেটের পুরুত্ব একই থাকে। আবার ফ্লাটপ্লেটের পুরুত্ব যত বেশি, একটি ভবন তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে, একটি ফ্লাটপ্লেট সাধারণের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পুরু করে নির্মাণ করা হয়, সুতরাং ভবনটি বোধ হয় মজবুত হলো। কিন্তু এর ফলে একটি তলার ভরও অনেকটা বেড়ে যায় এবং এই অতিরিক্ত ভরের কারণে ভূমিকম্পের মুহূর্তে ভবনের প্রতিটি তলায় বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের পার্শ্বশক্তি কাজ করে এবং ভবনকে ধরাশায়ী করতে সাহায্য করে। বিধ্বস্ত হয়ে একটির ওপর আরেকটি ফ্লাটপ্লেট স্যান্ডউইচ আকার ধারণ করে। তাই ফ্লাটপ্লেট দ্বারা ভবন নির্মাণ না করে বিম-স্ল্যাব দ্বারা করতে হবে।

ঢাকা শহরের প্রায় সব বাড়িতে তিতাস গ্যাসের লাইন আছে। জ্বালিয়ে রাখা গ্যাসের চুলা ভূমিকম্প হলে বিপর্যয় ঘটাবে। প্রয়োজন ছাড়া গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত ভয়ংকর। এমএমআইয়ের ৮ স্কেলের ঝাঁকুনিতে রান্নাঘরের গ্যাস বার্নার থেকে মুহূর্তে আগুন ধরে যেতে পারে। এ জন্য ভূমিকম্প যদি সকালের নাশতা বা দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার তৈরির সময় ঘটে, তবে আগুন লাগার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। জাপানের টোকিও-ইয়োকোহামা এলাকায় ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ দুপুর ১১টা ৫৮ মিনিটে ঘটা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে চার লাখ ৪৭ হাজার ১২৮টি ভবনে আগুন লেগে যায় এবং এক লাখ ৪২ হাজার ৮০৭ জন লোক মারা যায়। ৯৭ শতাংশই মারা গিয়েছিল আগুনে পুড়ে। এর অন্যতম কারণ, ভূমিকম্পটি ঘটেছিল এমন এক সময়, যখন প্রায় সব বাড়ি বা রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে চুলা জ্বলছিল। তাই মুহূর্তেই লাখো বাড়িতে আগুন ধরে যায়। অন্যদিকে জাপানের কোবে-ওসাকা এলাকায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৫ ভোর পাঁচটা ৪৬ মিনিটে ঘটা ৬ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে মাত্র সাত হাজার ৫০০টি ভবনে আগুন লাগে (ভবন বিধ্বস্ত হয়েছিল ৮২ হাজার) এবং আগুনে পুড়ে মারা যায় অল্প কিছুসংখ্যক লোক। এর অন্যতম কারণ, শীতের সকালে খুব ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই ছিল ঘুমে, অর্থাৎ রান্নাঘরের চুলা জ্বলছিল না। উল্লিখিত ভূমিকম্প দুটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ঝাঁকুনির ফলে আগুন লাগা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার কখন, তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিষয়টি এই সূত্র মানবে না, যদি বিনা কারণে গ্যাসের চুলা প্রায়ই জ্বালিয়ে রাখা হয়।

বাংলাদেশ তার সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার উত্তরে ৩২ কিলোমিটার মাটির গভীরে প্রকৃতির কাছ থেকে একটি ঘুমন্ত অপশক্তি পেয়েছে। আণবিক বোমার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, আণবিক বোমার সুইচ থাকে মানুষের হাতে কিন্তু এই অপশক্তি মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কবে নাগাদ এই অপশক্তির ঘুম ভাঙবে, সঠিকভাবে বলা সহজ নয়। সম্ভাব্য ঘুম ভাঙার কারণে শ পাঁচেক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যের সব স্থাপনা ভূমিকম্প সহনশীল হওয়া দরকার।

. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।