চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় আছি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘কোন কর্মকর্তা কোথায়, কখন আপনার কাছে ঘুষ দাবি করেছেন, কে কোথায়, কখন পাজেরো জিপ চেয়েছেন, কোন প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে কোন কর্মকর্তা জটিলতার সৃষ্টি করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক উপযুক্ত প্রমাণ আগামী সাত দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
সন্দেহ নেই, চিঠির ভাষা মোটামুটি শক্ত। কারণ অতিরিক্ত সচিব চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আপনার আনীত এই অভিযোগসমূহ গুরুতর। এতে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, যার প্রমাণ আবশ্যক।’

প্রকাশ্য সভায় চট্টগ্রামের মেয়রের খোলামেলা বক্তব্য এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রণালয়ের চিঠি—এ দুই মিলিয়ে রীতিমতো কৌতূহল ও উত্তেজনা আছে চট্টগ্রামবাসীর মনে। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মেয়রের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি বলে নানা ধরনের প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে কি এ বিষয়টিকে আর বাড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে ওপরমহল থেকে? সরকারের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া’র গতানুগতিক ধারণার মধ্যেই আটকে গেল পুরো রহস্যটা? নইলে মেয়র এর উত্তর দিচ্ছেন না কেন বা নির্দিষ্ট সময়ান্তে উত্তর না পেয়ে মন্ত্রণালয়ও নিশ্চুপ কেন?

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, কিছুদিন আগে ‘নগর সংলাপ’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে ক্ষোভে-দুঃখে প্রায় ‘বোমা’ ফাটিয়েছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রামের জন্য মাত্র ৮০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাকে যদি ৫ শতাংশ করে দিতে রাজি হতাম, তবে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আনতে পারতাম।’ এমনকি বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য একজন যুগ্ম সচিব একটি পাজেরো গাড়ি উপহার চেয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন মেয়র।
একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যিনি ক্ষমতাসীন দলেরও একজন নেতা, তাঁর কাছে কোনো আমলা অবৈধ অর্থ দাবি করতে পারেন—এ বিষয়টা সেদিন বিস্মিত করেছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের। পরদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর রীতিমতো ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে ওঠে এ খবর।

নাছিরের বক্তব্য বিশ্বাস করেছিল এ নগরের মানুষ। কারণ যতই ‘ভাবমূর্তি’র দোহাই দেওয়া হোক, যেকোনো সরকারের আমলেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকেন, এটা একটা সাধারণ ধারণা। সুতরাং নাছিরের বক্তব্যকে দ্বিধাহীন ও সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই গ্রহণ করেছে নাগরিকেরা। এর বড় প্রমাণ নাছিরের বক্তব্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর যখন মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠানো হলো, তখন এর প্রতিবাদে এ নগরে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন ইত্যাদি হয়েছে মেয়রের পক্ষে। একজন জনপ্রতিনিধির বক্তব্য আমলে নিয়ে এ বিষয়ে কোনো তদন্ত না করে উল্টো তাঁর কাছেই ব্যাখ্যা চাওয়া বা প্রমাণ করতে বলার মধ্যে আমলাতন্ত্রের যে ‘দাপুটে’ চেহারাটি প্রকাশিত হলো, সচেতন মানুষ তা পছন্দ করেনি।

যা-ই হোক, চিঠি পাওয়ার পর নাছিরকে খুব একটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়নি। বরং তিনি বলেছিলেন, সময়মতো এর জবাব তিনি দেবেন। এ নগরের মানুষ সেই ‘যথোপযুক্ত’ জবাবের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও এ বিষয়ে তিনি কোনো উদ্যোগ তো নিলেনই না, বরং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘লাস্ট ডেট (শেষ দিন) বলে কোনো শব্দ নেই। এটির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটি কোনো শোকজ না। আমি আমার পক্ষ থেকে যা করার করব এবং বলব।’ এত কিছুর পর এ ধরনের কথা যেন জনগণের কৌতূহল ও উত্তেজনার ওপর পানি ঢেলে দিল। সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে যাবে কি না, জনমনে সেই সংশয়ও তৈরি হলো।

হাজার বছরের ঐতিহ্যের শহর চট্টগ্রাম। এর উন্নয়ন-বঞ্চনার ইতিহাসও দীর্ঘ। জলাবদ্ধতা, ভাঙা রাস্তাঘাট, পাহাড় ধস, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, তীব্র যানজট ইত্যাদি কারণে চট্টগ্রাম শহরটি বসবাসের জন্য খুব উপযোগী অবস্থায় রয়েছে—এ কথা কেউ আজ বলবে না। অথচ পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও হ্রদ—প্রকৃতির এমন অপূর্ব সহাবস্থানের শহর সারা পৃথিবীতেই বিরল।
নানা সময়ে রাজনৈতিক সরকারগুলো চট্টগ্রামকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। যেমন, বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে চট্টগ্রামের ভাগ্যে জুটেছিল বঞ্চনা। এমনকি সে সময় (২০০১-০৬) সিলেটের চেয়ে অর্ধেকেরও কম বরাদ্দ পেয়েছিল চট্টগ্রাম। একই ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও। ২০১০ সালে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং চট্টগ্রাম থোক বরাদ্দ পেয়েছে কম।

এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ আশা করেছিল উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। তা ছাড়া ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগের নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা লালদীঘির মাঠের জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিলাম।’ কিন্তু একনেকে পাস হওয়া প্রকল্পের অর্থও যখন বরাদ্দ হয় না, তখন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নীতিনির্ধারক মহলের সদিচ্ছা সত্ত্বেও কেউ না কেউ এই পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ কারণেই মেয়র নাছিরের খোলামেলা অভিযোগ মানুষ বিশ্বাস করেছে এবং এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য যে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে খোদ এ নগরের বাসিন্দাদেরই সংশয় আছে। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা, এমনকি বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রীও প্রকাশ্যে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। অথচ এর জন্য বরাদ্দ ঠিকই পাওয়া গেল। আগে নাগরিকের সাধারণ অভাব (জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাট সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) পূরণ না করে ‘দর্শনীয়’ উন্নয়ন কতটা বাস্তবসম্মত তা ভেবে দেখা দরকার।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পরে আ জ ম নাছির বিলবোর্ড উচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছিলেন। তাতে তাঁর দৃঢ়চিত্ততা প্রকাশ পেয়েছিল। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে তাঁর কিছু পরিকল্পনা এ অঞ্চলের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু শুরুতেই প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পেয়ে তিনি হোঁচট খেয়েছেন। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। এ কারণেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে, ‘দুর্নীতিবাজ’ কিছু আমলার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে নাছির ‘লড়াকু’ ও ‘বেপরোয়া’ একটি ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চিঠির যথোপযুক্ত উত্তর না দিলে সেই ভাবমূর্তি কি রক্ষা হবে?
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, তবু আমরা অপেক্ষা করে আছি চিঠির উত্তর, একটি চিঠির জন্য।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]