ঋণ অবলোপন বনাম মওকুফ

.
.

ব্যাংকের মন্দ ঋণ অবলোপন বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট থেকে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রের তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বহুবিধ প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। ব্যাংকগুলো অবলোপনের মাধ্যমে মন্দ ঋণ কৌশলে আড়াল করার চেষ্টা করছে, আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে বেশুমার ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে, ঋণ অবলোপন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মুখে পড়ছে—এজাতীয় বিভিন্ন রকম বিশ্লেষণ উঠে আসছে। নানাবিধ মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন।
মূলত সব ধরনের ব্যবসাতেই অনাদায়ি পাওনার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়, সেটা ব্যাংকিং বা অন্য যেকোনো ব্যবসাই হোক না কেন। পাওনা আদায়ের ব্যবস্থা জোরদার না হলে যেকোনো ব্যবসাই বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, এমনকি লাটে উঠতেও পারে। পাওনা আদায়ের জন্য সম্ভাব্য সব পন্থা অবলম্বন করার পরও যদি দেখা যায় আদায়ের সব পথ রুদ্ধ, তাহলে সেই পাওনা অবলোপন করা যায়, এটি বিশ্বব্যাপী হিসাববিজ্ঞানের স্বীকৃত একটি পন্থা। এই ব্যবস্থার দুটি উদ্দেশ্য থাকে: একটি অবশ্যই স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্স শিটকে অনাদায়ি পাওনার ভারমুক্ত করা, অন্যটি অনাদায়ি পাওনার বিপরীতে আয়কর রেয়াত পাওয়া। কারণ, ঋণ অবলোপন করা ব্যবসায়িক লোকসান; লোকসানের বিপরীতে আয়কর প্রযোজ্য হয় না। তবে পরবর্তী সময়ে অবলোপন করা পাওনা যদি আংশিকভাবেও আদায় করা সম্ভব হয়, সে ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে আয়কর প্রযোজ্য হবে। এটিও আইনসিদ্ধ ব্যবস্থা। একই ব্যবস্থা ও নীতিতে ব্যাংকের আদায়-অযোগ্য খেলাপি ঋণ অবলোপন করার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট বিধান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। কারণ, বছরের পর বছর ধরে আদায়-অযোগ্য ঋণের হিসাব বহন করে ব্যালেন্স শিটের আকার ভারী করার মধ্যে কোনো বাস্তবতা নেই, বরং অনাদায়ি ঋণ ও তার বিপরীতে সংস্থানের পাহাড় গড়া একধরনের কৃত্রিম স্ফীতি। সুতরাং ব্যালেন্স শিটকে নির্ভার রাখতেই অন্য সব ব্যবসার মতো ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের বিধান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালের আগে মন্দ ঋণ অবলোপন করার কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ছিল না। অধ্যাপক ওয়াহিদউিদ্দন মাহমুদের নেতৃত্বে সরকারের ব্যাংকিং রিফর্ম কমিটি ২০০২ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ অবলোপন করাসহ কিছু নির্দেশনা-সংবলিত সুপারিশ দেয়। সেসব বাস্তবায়নের জন্য অবলোপনের পরও ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাতে অব্যাহত রাখা যায়, সে জন্য ব্যাংকিং কোম্পানি আইনেও আনতে হয় প্রয়োজনীয় সংশোধনী। এসব সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং খাতের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা অবলোপনযোগ্য হয়। এর আগে ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫, ৩১, ২৮ ও ২২ শতাংশ। ২০০৩ সালের নির্দেশনা পালন করে অবলোপন করার পর ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এই হার নেমে আসে যথাক্রমে ১৮, ১৪ ও ১৩ শতাংশে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, এই অঙ্ক অবলোপনকৃত ঋণ বাদ দিয়ে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপন করা ৪০ হাজার কোটি টাকার পুঞ্জীভূত ঋণ যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখÿ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ, কিন্তু অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে এই হার দাঁড়াবে ১৭ শতাংশ। সুতরাং লক্ষণীয়, অবলোপন করা ঋণ বাদ দিলে খেলাপি ঋণের হার কম দেখায়।
এসব কারণে ব্যাংকের ঋণ অবলোপন করা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়। সাধারণ মানুষ কেবল নয়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা যে ঋণ অবলোপন করা মানে কৌশলে মন্দ ঋণকে আড়াল করার চেষ্টা। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়। ঋণ অবলোপন করা হলেও সেই ঋণ আদায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। অর্থাৎ, অবলোপন মানে মওকুফ বা অব্যাহতি নয়। অবলোপনকৃত ঋণগ্রহীতা সেই ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত দায়মুক্তি পান না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপন বিষয়ে ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে জারি করা সার্কুলারের মাধ্যমে যে নির্দেশনা জারি করেছে, তার শর্তগুলো লক্ষ করলেই বিভ্রান্তিটা ¯দূর হতে পারে। শর্তগুলো এ রকম: ১. মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকৃত হয়েছে এ রকম ঋণ যেকোনো সময় অবলোপন করা যাবে, তবে এই শ্রেণীকরণের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং ১০০ শতাংশ সংস্থান করা হয়েছে এ রকম ঋণ অবশ্যই অবলোপন করতে হবে। এমনকি কোনো ঋণের বিপরীতে পূর্ণ সংস্থান করা না থাকলেও চলতি বছরের আয় থেকে তা পূরণ করে অবলোপন করা যাবে। ২. অবলোপনের আগে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা করতে হবে (পরবর্তী সময়ে ৫০ হাজার টাকার কম ঋণ অবলোপনের জন্য মামলা করার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে।)। ৩. অবলোপন করা ঋণ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ৪. অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। ৫. অবলোপন করা হলেও সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং সিআইবিতে তা যথানিয়মে রিপোর্ট করতে হবে। ৬. অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব পৃথক লেজারে সংরক্ষণ করতে হবে এবং ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টে ক্রমপুঞ্জীভূত ও চলতি বছরের অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। ৭. ব্যাংকের পরিচালক কিংবা সাবেক পরিচালক এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অবলোপন করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা উচিত যে গৃহীত ঋণের আসল অংশটুকু কখনোই কোনো অবস্থাতেই মওকুফ কিংবা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ঋণের আসল আদায়ের জন্য অবলোপন করা হলেও ব্যাংকগুলোকে আসল আদায়ের জন্য কেয়ামত পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে।
এত সব নির্দেশ ও নীতিমালার ফাঁক গলিয়ে অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব আড়াল করা আদৌ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, অবলোপন করা ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার দুঃসংবাদটা জনগণের কাছ থেকে লুকাতে চায় কিংবা ঋণখেলাপি রাঘব বোয়ালদের গণরোষ থেকে আড়াল করতে চায়—এজাতীয় ঢালাও মন্তব্যও অভিপ্রেত নয়। ঋণ অবলোপনের এই বিতর্কে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নরও। তিনি এই অবলোপনকে একধরনের ‘কেলেঙ্কারি’ বলে মনে করেন, কারণ ছোট গ্রহীতাদের মাফ করা না হলেও বড় গ্রহীতাদের ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বড় গ্রহীতাদের ঋণ অবলোপন করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযান কোনো কিছুই শিথিল করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক যদি ঋণ অনুমোদনে কোনো ধরনের শৈথিল্য না দেখায় এবং অবলোপনের সব পূর্বশর্ত পালন করে, তাহলে এটিকে স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবসায়িক ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা যায়। সুতরাং পরিণতিহীন ঋণ হিসাব ব্যালেন্স শিটে ধরে রেখে সম্পদ স্ফীত করে না দেখিয়ে অবলোপন করে ফেলাই স্বাস্থ্যপ্রদ। ২০০৩ সালের আগে ব্যাংকগুলোর সামনে কোনো নীতিমালা না থাকায় তাদের ব্যালেন্স শিটের সম্পদ অংশ ছিল কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত।
তবে অবলোপনের আপাতত সুফল যেমনই হোক না কেন, এটির সমালোচনাকারীদের যুক্তি অনেক ভারী ও সংগত। প্রথমত, ঋণ অবলোপনের কারণে সরকারের কর আদায় বাধাপ্রাপ্ত হয়, কারণ ব্যাংকগুলো অবলোপনের কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক ক্ষতির জন্য কর অব্যাহতি পায়, ফলে সরকারের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হন লভ্যাংশ থেকে, কারণ অবলোপনের প্রথম শর্তই হচ্ছে মুনাফা থেকে সরিয়ে মন্দ ঋণের বিপরীতে সংস্থান সৃষ্টি করা। এতে বার্ষিক লভ্যাংশের হার কমে যায়। (তবে অবলোপন করা না হলেও ‘মন্দ’ শ্রেণিভুক্ত ঋণের বিপরীতে পূর্ণ সংস্থান করতে হয় বলে বার্ষিক লভ্যাংশের হার ক্ষতিগ্রস্ত হয়) তৃতীয়ত, ব্যাংকের সুদের হারের ওপরও অবলোপনের বিরূপ প্রভাব পড়ে। অনাদায়ি মন্দ ঋণের পরিমাণ বেশি হলে ব্যাংকের তহবিল খরচ (কস্ট অব ফান্ড) বেশি থাকে, ফলে আমানতের ওপর কম সুদ ও ঋণের ওপর সুদের হার বাড়াতে হয়। এতে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ঋণ অবলোপনের এসব বিরুদ্ধচারিতা মোকাবিলা করার জন্য ব্যাংকগুলোকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে অবলোপনের মতো চরম ব্যবস্থা না নিতে হয়। ঋণ অবলোপনের যত কিছুই পূর্বশর্ত থাকুক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অবলোপনের পর ব্যাংকের ঋণ আদায়কারীদের দৃষ্টি অবলোপনকৃত ঋণ থেকে দূরে সরে যায়। উপরন্তু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার নির্ণয় করার সময় অবলোপন করা ঋণ হিসাবে ধরা হয় না বলে খেলাপি হার বাস্তব অবস্থার চেয়ে কম প্রতিভাত হয়। এটি ব্যাংকগুলোকে একধরনের আত্মতৃপ্তি দেয়, ফলে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের উদ্যোগে শিথিলতা আসে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রকাশের সময় যাতে অবলোপনকৃত ঋণও গণনা করা হয়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক মানেও খেলাপি ঋণের হারের সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের হার যোগ করা হয়, যাতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত হয়। অবলোপনকৃত ঋণ বাদ দিলে খেলাপি ঋণের হার কম দেখায় বটে, কিন্তু তাতে খেলাপি ঋণের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় না।
বাস্তবতা হচ্ছে, অবলোপনের মতো চরম ব্যবস্থা যাতে নিতে না হয়, তার জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, ঋণ ঝুঁকি বিভাগকেও এই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে বৃহৎ করপোরেট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি তথা এসএমই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঋণ ঝুঁকি নির্ধারণে পার্থক্য চিহ্নিত করতে হবে, যাতে এসএমই খাতের ঋণগ্রহীতারা বঞ্চিত না হন। এই ভারসাম্য রক্ষা করে সঠিক মূল্যায়ন করা হলে অবলোপনের মতো চরম ব্যবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
[email protected]