বিলম্বে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে

ব্যাপক আয়োজনের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২২ নভেম্বর ২০১৩ শেষ হয়েছে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ নগরে। ধনী দেশগুলোর শত শত বছরের ভোগবাদী দর্শনতাড়িত জীবন এবং তার উপাদানসমূহের জোগান নিশ্চিত করতে পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে যে বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরিত হয়েছে, তাতে পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণায়ন আরও দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে কি না, তা নিয়ে গুরুতর সংশয় রয়েছে। বলাই বাহুল্য, দ্রুত সম্পদশালী ও উন্নত হয়ে ওঠার দৌড়ে যে দেশগুলো এগিয়ে, তারাও দূষণে পিছিয়ে নেই। রাখঢাক ছাড়াই তারা নিজেদের জীবনমান উন্নত করার প্রয়োজনে পরিবেশ দূষণ করার দায় নিজেদের ঘাড়ে নিতে অনিচ্ছুক।
আবার প্রবল সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০১১ সালের মার্চ মাসে জাপানের ফুকুশিমা দাই-চি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ শতাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎনির্ভর জাপানকে তার প্রায় সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। ফলে, জাপানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। সম্প্রতি জাপান ফুকুশিমা এলাকায় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান একই সঙ্গে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ। ফলে, জাপান যখন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে যে ২০২০ সালের মধ্যে তারা তাদের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ (১৯৯০ সালের সূচক পর্যায়) লক্ষ্যমাত্রা ২৫ শতাংশ হ্রাস করার পূর্বঘোষণা থেকে সরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় পুনর্নির্ধারণে বাধ্য হচ্ছে, তখন বিশ্বের উষ্ণায়ন হ্রাস করার চ্যালেঞ্জ কঠিনতর হয়ে উঠছে। বাড়তি হিসেবে, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কয়লা উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশ অস্ট্রেলিয়া তার গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার কথা ভাবছে। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৮ এর অন্যতম সদস্য কানাডা ইতিমধ্যে ‘কিয়োটো প্রটোকল’ (১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা ২০১২ সালের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে ৫ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে) থেকে বেরিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরই করেনি।
আগামী ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কিয়োটো প্রটোকলের পরবর্তী ধাপ হিসেবে বিশ্বের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা সুনির্দিষ্ট করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘বর্ধিত কার্যক্রম’ গ্রহণের পদক্ষেপ নির্ধারণ করে ২০২০ সাল থেকে তা প্রয়োগের চুক্তি যেন চূড়ান্ত হতে পারে, তার আলোচনা হলো ওয়ারশ সম্মেলনে।
এদিকে বিজ্ঞানীরা বিশ্বে আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণায়ন হ্রাস করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। এ জন্য মানুষের সাধ্যের মধ্যে করণীয় গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ দ্রুত হ্রাস করা গুরুত্বপূর্ণ; নইলে প্রাক-শিল্পবিপ্লব পর্যায়ের সঙ্গে বাড়তি দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার ‘লক্ষণরেখা’ অতিক্রান্ত হলে বিপর্যয় অবধারিত। যুক্তরাজ্যের জ্বালানিমন্ত্রী এড ডেভিস ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, ব্রিটিশ ট্যাক্সদাতাদের অর্থ উন্নয়নশীল দেশে আর কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় করা হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিলের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্য গত সাত বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন কয়লা প্রকল্পে উন্নয়ন ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে জোগান দিয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কয়লা খনি উন্নয়ন ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জোগান দিয়েছে প্রায় নয় বিলিয়ন ডলার। একই খাতে জার্মানি ও জাপান অর্থ জোগান দিয়েছে যথাক্রমে ছয় ও নয় বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য, শেষোক্ত দেশ দুটি এখনো ব্রিটিশ মন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া না দিলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ উন্নয়নশীল দেশে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগে অর্থ জোগান না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান (১৮ নভেম্বর ২০১৩) যুক্তরাজ্যের তিনটি বড় ব্যাংক, রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড (আরবিএস), বার্কলেস এবং এইচএবিসি গত আট বছরে যথাক্রমে পাঁচ বিলিয়ন ইউরো, ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো এবং ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো বিভিন্ন দেশে কয়লা খনিশিল্পের উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে।
এ ছাড়া পৃথিবীর বড় ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটিগ্রুপ, মর্গ্যান স্ট্যানলি এবং ব্যাংক অব আমেরিকা বিশ্বজুড়ে কয়লা খনিশিল্পে বিনিয়োগ করেছে। এক গবেষণা রিপোর্টের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মিলিতভাবে কয়লাখনিশিল্পে ৫৭ শতাংশ তহবিল জোগান দিয়েছে। তা ছাড়া, যুক্তরাজ্যে ২০১২ সালে ৩৯ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে কয়লা দিয়ে, ২০১১ সালে এ পরিমাণ ছিল ২৯ শতাংশ। দি ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় এক হাজার ২০০ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা এক হাজার ৪০০ গিগাওয়াট (১৪ লাখ মেগাওয়াট)। ২০১০ সালে বিশ্বের আবহাওয়ামণ্ডলীতে উদিগরিত মোট কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৪৩ শতাংশ এসেছে কয়লা থেকে। চীন আগামী ২০২২ সাল অবধি প্রতিমাসে অন্তত তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনা অব্যাহত রাখবে এবং ভারত ইতিমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
সুতরাং বিশ্বে কয়লার ব্যবহার কমছে না। তবে কয়লা খনি উন্নয়ন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আমাদের মতো দেশ, যারা বিলম্বিত এবং দ্বিধাগ্রস্ত যাত্রাশুরু করেছে, তাদের জন্য বিনিয়োগ দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল হবে। বাড়তি হিসেবে এখন কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রচলিত এবং দূষণপ্রবণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বদলে অপেক্ষাকৃত দক্ষ ও কম কার্বন দূষণক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি মনে করে, বিদ্যমান ৩৩ শতাংশ দক্ষতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থলে ৪৫ শতাংশ দক্ষতার নতুন প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে বিশ্বে বছরে প্রায় ২ দশমিক ৪ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস পাবে। অনেক জায়গাতেই পুরোনো প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে নতুন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে নতুন প্রযুক্তির জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হবে। বাংলাদেশের মতো বিনিয়োগ-দৈন্যের দেশে সেই চ্যালেঞ্জ আরও বড়।

ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী এবং জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।