রুদ্ধশ্বাস নাটক ও দুই প্রতিমন্ত্রী

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

যুদ্ধাপরাধীদের যথাবিচারিক শাস্তি কার্যকর দেখতে লক্ষ-কোটি মানুষ যখন অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, তখন ক্ষমতাসীন দলের অতি-উৎসাহীরা একটি শ্বাসরুদ্ধকর নাটকের জন্ম দিলেন। অনেকের কাছে মেনে নেওয়া কষ্টকর হলেও চেম্বার জজ ও সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। সরকার অহেতুক দোষী সাব্যস্ত হতো। সেই দায় থেকে তাঁরা বাঁচিয়ে দিলেন। যথাযথ বিচার-প্রক্রিয়া নিঃশেষিত হওয়া ছাড়াই কাদের মোল্লার ফাঁসি বিতর্ক ভুল-বোঝাবুঝি ও বিভেদ বাড়াতে উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হতো।
আমরা একটি বিচার বিভাগীয় বিশেষ পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ করলাম, এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন বিবাদ মেটাতে ঢাকায় অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ব্যস্ত, জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়াররা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক না থাকার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তখন বিশ্ব দেখল, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর সরকারকে ‘না’ বলতে পারে। ক্রান্তিকালের এই অর্জন অসামান্য।
‘রিভিউ আইনসংগত বিএনপি কৌশলগত’ শীর্ষক নিবন্ধে গত ১৮ সেপ্টেম্বর যে মন্তব্য করেছিলাম, তা এভাবে ফলবে ভাবিনি। মন্তব্যটি ছিল: ‘দেশের বিরাজমান বাস্তবতায় দলীয়করণ দোষে দুষ্ট একটি সরকারের পক্ষে এ নিয়ে অনভিপ্রেত বিতর্ক করা কিংবা রিভিউর শুনানি হতে না দিয়ে তাড়াহুড়ো করা কিংবা অতি-উৎসাহীদের কবলে পড়া কিংবা নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ফায়দা লাভের প্রবণতায় ফাঁসির রায় কার্যকর করতে উদ্যোগী হওয়া অথবা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রায় কার্যকর করা কিংবা বিলম্বিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা বুমেরাং হতে পারে।’
আইনমন্ত্রী হিসেবে শফিক আহমেদ এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কাদের মোল্লাকে ফাঁসির রায় দানের দিন থেকেই দাবি করেন যে, তিনি রিভিউর সুযোগ পাবেন না। রিভিউ আসলে নিতান্ত মামুলি ও ঠুনকো বিষয়। কালক্ষেপণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এ নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে কেন তাঁরা আইনি ব্যাখ্যাদানে ব্যাকুল হয়েছিলেন, সেও এক প্রশ্ন। এর বিপরীতে অন্যদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ রিভিউর সুযোগ আছে বলেই মত দিয়েছিলেন। আমরাও ওই অবস্থান সমর্থন করেছিলাম। রিভিউর অধিকার যেকোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এটা কে পাবে বা পাবে না, সেটা নিশ্চিত করাও আপিল বিভাগের সাংবিধানিক অধিকার। দৃশ্যত দুই প্রতিমন্ত্রী এটা হরণ করতে চেয়েছিলেন। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলেকে একটি টিভি চ্যানেলে অহেতুক তাড়াহুড়ো করার ব্যাপারে মঙ্গলবার রাতে দুঃখ প্রকাশ করতে শুনলাম। তিনি ঠিকই বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিচার নিবিড়ভাবে লক্ষ করছে। সুতরাং এখানে দরকার নিয়মরীতি মেনে চলতে বাড়তি সতর্কতা। অথচ আমরা একি দেখলাম!
এটা সন্দেহাতীত যে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রী সরকারের ‘অতি-উৎসাহী মহলের’ নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণ করে দেওয়া সম্ভব যে বাংলাদেশকে কয়েক ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর নাটকে ফেলার জন্য তাঁরাই প্রধানত দায়ী। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, সবকিছু নিয়েই খেলা করা চলে। এর সঙ্গে আইনের শাসনের ব্যাপার নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তাই এটা একেবারেই বোধগম্য নয় যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরের সত্যতা কতটুকু।
চেম্বার জজ স্টে করে জাতিকে বিচারিক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন—এটা মানতে পারলে এটাও মানতে হবে যে, দুই রাজনীতিক দুই প্রতিচরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা রাষ্ট্রের আইন ও নিয়মরীতি খেলার সামগ্রীতে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা মো. নাসিম বলেছেন, ‘১৪ দল মনে করে, সরকারের দায়িত্বে থেকে কোনো মন্ত্রী বিরূপ মন্তব্য করেছেন। রায় নিষ্পন্ন হওয়ার আগে এ ধরনের মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।’ এটা ১৪ দলের বিষয় নয়, মন্ত্রিসভার খাস তালুকের বিষয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পাঁচ খুনির ওপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয় ৩ জানুয়ারি ২০১০। জেল কোড অনুযায়ী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামির রায় কার্যকর হবে মৃত্যু পরোয়ানা জারি থেকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয়। সে অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার শেষ দিন ছিল ৩১ জানুয়ারি ২০১০। আমরা তখন অনাবশ্যক তাড়াহুড়ো দেখিনি। একটানা তিন দিন শুনানি শেষে রিভিউ আবেদন নাকচ হয়েছিল ২৭ জানুয়ারি সকালে। আত্মীয়স্বজন সাক্ষাৎ সারেন বিকেলেই। প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয় ফাঁসির রাতেই। সাংবাদিকেরা ২৭ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীকে যথারীতি ঘিরে ধরেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সাবধানতা অবলম্বন করেন। সতর্ক আইনমন্ত্রী শুধু এতটুকু বলেছিলেন, ‘৩১ জানুয়ারির মধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর হবে।’ অথচ তিনি জানতেন, ওই দিনই মধ্যরাতে ফাঁসির রায় কার্যকর হবে। কখন ফাঁসি হবে, তা জানিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেননি। অথচ এবার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটানো হলো। বিশ্বকে এবং বিচারপ্রত্যাশীদের মধ্যে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে অহেতুক সংশয়ের বীজ ঢোকানো হলো।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসভবনে প্রেস ব্রিফিং ওপরের নির্দেশেই ঘটেছে ধরে নিতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রীর একক দায়িত্ব বা ব্যর্থতা গণ্য হয় না। এটা সমষ্টিগতভাবে গ্রহণ করার বিষয়। দুই প্রতিমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং মানে মন্ত্রিসভারই সিদ্ধান্ত। যদি তাঁরা মন্ত্রিসভা বা সরকারকে জনগণের সামনে হেয় করে থাকেন, তাহলে তাঁদের সামনে দুটি পথ খোলা—হয় তাঁদের ক্ষমা চাইতে হবে, না হলে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইজি প্রিজন কী দোষ করলেন, তা বোধগম্য নয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়া থেকে এক মাসের মধ্যে রিভিউ দরখাস্ত করা যাবে। মঙ্গলবার রাতে আনিসুল হক ১৫ মিনিট থেকে অনধিক চার দিনের মধ্যে এর নিষ্পত্তি আশা করেন। আপিল বিভাগের রায়ে বড় ধরনের গলদ না দেখাতে পারলে রিভিউ অচল।
জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী বলেন, ৮ ডিসেম্বর মৃত্যু পরোয়ানা পাওয়ার দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে কাদের মোল্লার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আইন যদি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে থাকে, তাহলে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো না কেন? আইন প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন, দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কাদের মোল্লার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না। কাদের মোল্লা তা নাকচ করেছেন।
এখানে কথা হলো, কাদের মোল্লা নাকচ করলেও আইন যেহেতু তাঁকে সাত দিনের সুযোগ দিয়েছে, তাই সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কারণ, নাকচ করলেও তিনি যে তাঁর সিদ্ধান্ত সাত দিনের মধ্যে বদলাতে পারবেন না, সেটা সরকার ধরে নিতে পারে না। আইন প্রতিমন্ত্রীর রিভিউ-বিরোধী অবস্থান নিজের দায়ের কোপে নিজের আঙুল কাটার সমতুল্য। কারণ, রিভিউ-বিরোধীরা যুক্তি দিচ্ছেন, আইনে রিভিউ করার অধিকারের কথা লেখা নেই। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে রিভিউর যে বিধান আছে, তা যুদ্ধাপরাধ বা দালাল আইনে দণ্ডিতদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, সংবিধানের ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ বলেছে, এ ধরনের দণ্ডিতদের ‘কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার’ অধিকার থাকবে না।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের স্বপ্রণোদিত সময়ের গণজাগরণকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম সরকারের ওপর অবিশ্বাস থেকেই তারা ক্ষোভে ফেটেছে। জনতার শক্তিতে ভীত সরকার ও তার মিত্ররা এটা দ্রুত ছিনিয়ে নিল। এই বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী ‘চোখের বিনিময়ে চোখ’ নীতির অনুসারী নয়। তারা ভেবেছিল, যাবজ্জীবনে বিশ্বাস কী, সরকার এদেরকে ছেড়ে দেবে। তাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমা দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না করতে আইন বানাতে বলেছিলাম। সেই সঙ্গে এও বলেছি যে, সংবিধানের একটি ব্যাখ্যা মানলে নতুন আইন লাগবে না। আসুন, মেনে নিই, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত ৪৯ অনুচ্ছেদের সুবিধা সাধারণভাবে দণ্ডিত অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য। এর আওতায় দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা প্রতিকার পাবেন না। একজন আইনজ্ঞ গতকাল আমাকে টেলিফোনে বলেন, ‘আইন প্রতিমন্ত্রী কী করে মোল্লার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার অধিকারের কথা বলেন। এটা তো প্রতিকার। সংবিধান এটা নিষিদ্ধ করেছে। আর রিভিউ প্রতিকার নয়, অথচ তিনি এর বিরোধিতা করছেন।’ আমি তাঁর সঙ্গে একমত হই।
আইনমন্ত্রী থাকতে শফিক আহমেদের সঙ্গে এ নিয়ে একদিন কথা হলো। সেখানে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ছিলেন। তিনিও একটি মার্জনানিরোধ আইন করার প্রবক্তা। আমরা উভয়ে আইনমন্ত্রীকে এটা বললাম। তিনি বললেন, এখন আর সংবিধান সংশোধনের সুযোগ নেই। বললাম, সংবিধান সংশোধনের দরকার নেই। ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন করে একটা রক্ষাকবচ তৈরি করে রাখুন। মৃদু কণ্ঠে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন।
দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীকে জিন্টু বা তাহেরপুত্রের মতো ক্ষমা পেতে দেখলে জনতা অবশ্যই গর্জন করবে। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ আইনটা করল না কেন? এই বিচার চাইলে কেবল তাদেরকে রাখতে হবে বলেই কি?
আইন প্রতিমন্ত্রী স্পষ্টতই একটি স্ববিরোধী সাংবিধানিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এক মুখে দুই কথা বলছেন। রিভিউ অধিকার নেই অথচ প্রাণভিক্ষার সাংবিধানিক অধিকার আছে। আরও একটি গুরুতর স্ববিরোধী অবস্থান তাঁর আছে। এটা আপিল বিভাগের অবমাননাও। কারণ তিনি বলেন, ‘যদিও আইনে রিভিউ করার সুযোগ নেই, তবু আমরা ভেবেছিলাম যে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর দ্রুত তাঁরা সাজা স্থগিতের জন্য হয়তো চেম্বার জজের কাছে যাবেন কিন্তু রোববার থেকে তিন দিন সময় পেলেও তাঁরা যাননি। সুযোগ গ্রহণ করেননি, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।’ কে তাঁকে তিন দিন মঞ্জুর করার এখতিয়ার দিল?
কোনো সন্দেহ নেই, জামায়াতের নেতারা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন এবং এই বিচার-প্রক্রিয়াকে কী করে বানচাল করা যায়, সেই চেষ্টা তাঁদের রয়েছে। তাঁদের মিত্র বিএনপির সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁরা যে নাশকতায় লিপ্ত রয়েছেন, তারও মূলে রয়েছে ওই বিচার ভেস্তে দেওয়ার অপচেষ্টা। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মনোজগতে কী আছে, সেটা তো আমরা ঔদাসীন্যে উড়িয়ে দিতে পারি না। অপরিণামদর্শী দুই প্রতিমন্ত্রী যে বিভ্রান্তি ছড়ালেন, সেটাও একটা বিরাজনীতিকীকরণ, এর প্রতিকার কে দেবে? এটুকু অনুমেয়, এই নাটকের এটাই শেষ দৃশ্য নয়।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]