বিড়ম্বিত ভ্রমণে গর্বের পাঁচালি

যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে এসেছি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি এয়ারলাইনসের প্রধান কার্যালয়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বুক করেছি। এবার টাকা দেওয়ার পালা। কর্তব্যরত কর্মকর্তা দেখেশুনে বললেন, যেহেতু লন্ডন হয়ে যাচ্ছি, ভিসা নিতে হতে পারে। বিভিন্ন সময়ে লন্ডন হয়ে আমেরিকায় গিয়েছি, কিন্তু কখনো ভিসা লাগেনি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলাপ করতে গেলেন এবং দীর্ঘ সময় পর ফিরে এসে তাঁর উদ্বেগের সত্যতার কথা জানালেন। ট্রানজিটে যেহেতু তারিখ পরিবর্তন হচ্ছে, এ জন্যই ভিসা লাগবে। অর্থাৎ রাত ১১টা ৫০ মিনিটে হিথরোতে পৌঁছে দিবাগত রাত একটায় রওনা হলেও ভিসা লাগবে। আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হতো না। এখন তো প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় অন্ধকারে থাকতে হয়। উপনিবেশের অর্থকড়ি তো আর পাওয়া যাচ্ছে না, এখন ট্রানজিট ফি বা এ ধরনের নানা কিছুকেই সম্ভবত দেশটি অর্থ আদায়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে!
তার পরের দিন তারিখ পরিবর্তন করতে হয় না, এমন একটি কানেকটিং ফ্লাইটের টিকিট কিনলাম। কম্পিউটারে প্রিন্ট করা টিকিটের সঙ্গে নানা বর্ণে ছাপানো একটি পাতাও জুড়ে দেওয়া। আসার আগের দিন দেখলাম, সেই রঙিন লেখা পৃষ্ঠায় তিনটি সুটকেসের ছবি; পাশে লেখা: ইকোনমি ক্লাসে আগে ২৩ কেজি নেওয়া যেত, এখন ৩০ কেজি; বিজনেস ক্লাসে আগে ৩০ কেজি, এখন ৪০ এবং ফার্স্ট ক্লাসে আগে ৪০ কেজি, এখন ৫০ কেজি। এমন লোভনীয় অফার আবিষ্কার করে তো খুব খুশি। তা–ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইনসটির প্রধান কার্যালয় থেকে নিশ্চিত হতে ইন্টারনেটে পাওয়া টেলিফোন নম্বরে ফোন করলাম। অনেকবার করার পরও কেউ ধরল না। ই-মেইল করলাম। উত্তর নেই।

>কেউ সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন, কেউ বা অধ্যাপনায়, কেউ বা শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন

প্রতিদিন দুটি করে ফ্লাইট যাচ্ছে ঢাকা থেকে, যোগাযোগ তো খুব ভালো হওয়া দরকার। তখন আমিও ২৭ কেজি করে দুটি লাগেজ ঠিক করে বিমানবন্দরে উপস্থিত হলাম। যখন আমার পালা এল, কাউন্টারে সেবাদানকারী বললেন, ওজন কমিয়ে ২৩ কেজি করতে হবে। তখন রঙিন কাগজটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বললেন, এর পরিবর্তন হয়েছে, এটা প্রযোজ্য নয়। আমি কিন্তু মাত্রই ২০ দিন আগে টিকিট কিনেছি, শর্তাবলিতে পরিবর্তন হলে তা তো এয়ারলাইনসেরই দায়িত্ব নিয়ে জানানো উচিত। ভদ্রলোক আবার ইন্টারনেটের তথ্যের কথা বললেন সম্ভবত এই ভেবে যে আমার মতো বয়স্ক লোক হয়তো জানেন না। তাতেও তিনি রীতিমতো রাজার আসনে বসে কথা বলছেন, যদিও তাঁর সেবা দেওয়ার কথা। আমার বয়স এমনকি আমার চাকরিস্থল কিংবা আমার পদবি, কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না। একসময় বললেন তিনি আমাকে আর সুযোগ দেবেন না, মানে যেতেই দেবেন না। আমার ৪৪ বছরের বিমানভ্রমণের জীবনে এ রকম অবস্থার সম্মুখীন হইনি। অনেক কষ্টে তাঁকে সন্তুষ্ট করার মতো অবস্থায় এনে যখন চেকইন সম্পন্ন করা হলো, তখন আর আমার দেহে শক্তি অবশিষ্ট নেই।
মিলওয়াকিতে ছেলের বাসায় পৌঁছালাম ১১ আগস্ট বিকেলে। ১২ তারিখ সকালে ডালাসের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার একসময়ের ছাত্র সহকর্মী এবং বর্তমানে ইউটি ডালাসের অধ্যাপক লতিফুর রহমান খানের আমন্ত্রণে একটি সেমিনারে। রাতে ড. পল্লবী পারভীন এবং তাঁর বাসায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অনেক স্নাতকের সঙ্গে দেখা হয়; যাঁরা স্বীয় কর্মস্থলে যোগ্যতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। স্বদেশে চেকইনে সমস্যা হলেও পরদেশে চেকইনে সমস্যা হয়নি। ১৩ তারিখ সকালে অধ্যাপক লতিফুর রহমান খানের সঙ্গে সান ফ্রান্সিসকো রওনা হলাম। নিজে ইকোনমি ক্লাসে গিয়ে আমাকে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। ড. ফারিবার গাড়িতে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু। আমার ছয় ঘণ্টা অবস্থানের জন্য আমাদের স্নাতকেরা যে আয়োজন করেছিলেন এবং তাতে উপস্থিতি দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত। প্রত্যেকে নিজ কর্মক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ। বিভাগের শুরুর দিনগুলোতে আমাদের ল্যাবে দুটি কম্পিউটার, যার একটিতে মাত্র ১০ মেগাবাইট হার্ডডিস্ক, পালাক্রমে তাতে কাজ করে আমাদের স্নাতকদের অর্জনের কোনো তুলনা নেই। কেউ সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন, কেউ বা অধ্যাপনায়, কেউ বা শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। দেশের প্রতি মমত্ববোধ রয়েছে প্রচুর। তাইতো অল্প সময়ের জন্য হলেও একটি রেস্টুরেন্টে সবাই একত্র।
বিকেলেই রওনা হলাম সিয়াটলের দিকে। আমাদের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র মাইক্রোসফট রিসার্চের খ্যাতিমান গবেষক ড. সুমন কুমার নাথ তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন; তুখোড় প্রোগ্রামার মুনিরুল আবেদীনের সঙ্গে দেখা। সন্ধ্যায়ই আমাদের প্রথম ব্যাচের ‘লাস্ট বয় ফার্স্ট’ সন্দীপন সান্যালের ছোট ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বর্তমানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনেক মেধাবী স্নাতকের সঙ্গে দেখা হলো। একেকজনের সঙ্গে দেখা হয়, আর বুক এক বিঘত করে বেড়ে যায়, দেহে আর বুক লুকানোর জায়গা নেই।
এরপর ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেনে গেলাম। সেখানে আমাদের অনেক গ্র্যাজুয়েট। আহমেদ খুরশিদের পিএইচডি গবেষণার ফল এতই ভালো যে তাঁকে ভিত্তি করে একটি স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য অর্থায়ন হয়েছে এবং তাতে তাঁর দুই পিএইচডি সুপারভাইজারও যোগ দিয়েছেন। ফেসবুকের চাকরি ছেড়ে সুবিশাল বাড়ি কিনে ড. মেহেদি বখতও সেখানে যোগ দিয়েছেন। মেধাবী স্নাতক মারকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইকবাল আহমেদের উপস্থিতির সুবাদে সেখানেও বাংলাদেশের অনেক ছাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সীমিত সম্পদ ও সুযোগের মধ্যে পড়ালেখা করেও আমাদের ছাত্রদের ঈর্ষণীয় উন্নতি দেখে খুশিতে মন ভরে গেল। দেশ ছাড়ার সময় এয়ারলাইনসের চেকইনে যথেষ্ট নিগৃহীত হওয়ার যন্ত্রণা আর রইল না।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।