আসুন, সবাই মিলে রাঁধিবাড়ি

আমাদের দেশের নাটক বা সিনেমার তারকাদের যখন প্রশ্ন করা হয়, কী খেতে বেশি ভালোবাসেন? তখন বেশির ভাগেরই উত্তর থাকে মায়ের রান্না করা কোনো পদের কথা। কেউ বলেন, মায়ের হাতের ছোট মাছের চচ্চড়ি। কেউ বলেন, গরুর মাংসের বিরিয়ানি। কেউ বলেন, মুরগির ঝোল। সবাই শুধু মায়ের হাতের রান্নার কথা বলেন। বাবার রান্না করা খাবার কারও ভালো লাগে—এমনটা কেউ কখনো বলেন না। কারণ একটাই, তাঁদের বাবারা রাঁধেন না।
পাঠকেরা হয়তো বলবেন, এ কেমন কথা? বাবারা, অর্থাৎ ছেলেরা আবার রাঁধেন নাকি? রাঁধেন তো মায়েরা, অর্থাৎ মেয়েরা। এটাই স্বতঃসিদ্ধ। এটাই আমরা চিরকাল দেখে এসেছি। আমাদের দেশের কোনো পরিবারের পুরুষ সদস্যটি দিনের পর দিন রেঁধে যাচ্ছেন—এমনটি বলতে গেলে দেখাই যায় না। তাঁরা কালেভদ্রে রান্না করেন। বাড়ির নারী সদস্যটি অসুস্থ হয়ে পড়লে বা বাড়ির বাইরে গেলে তাঁরা বাধ্য হয়ে রাঁধেন। এ ছাড়া প্রবাসে গেলে বা পরিবার থেকে যখন বিচ্ছিন্ন থাকেন, তখন রাঁধেন। তবে কিছু পুরুষ অবশ্য নিয়মিতই রাঁধেন। সেটা অবশ্য বাড়িতে নয়, হোটেল বা রেস্তোরাঁয়। পৃথিবীর সেরা রাঁধুনিদের বেশির ভাগই কিন্তু পুরুষ। পুরুষেরা চাইলেই যে ভালো রাঁধতে পারেন, তার প্রমাণ এই রাঁধুনিরা। এ প্রসঙ্গে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। যেমন টমি মিয়া, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক ব্রিটেনের রানির অফিশিয়াল শেফের দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছেন। আরেকজন বিখ্যাত রাঁধুনি ভারতের সঞ্জীব কাপুর। তিনি তো রান্নাকে মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আর আমাদের দেশের ফখরুদ্দীন বাবুর্চির কথা তো সবাই জানে। এই পুরুষেরা রান্না করেই বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সবাই আজ তাঁদের চেনে।
পুরুষদের বলছি, রান্নার কাজটা মোটেও খারাপ বা ছোট কাজ নয়। এতে মোটেও লজ্জা নেই। এটা যদি লজ্জার ব্যাপারই হবে, তাহলে নারীর রান্না করা খাবার পুরুষেরা খান কেন? নারীরা না রাঁধলে তো ঘরে পুরুষদের খাবারই জুটবে না। নারীর রান্না করা খাবার খেয়েই তো তাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। আবার এই নারীর রান্নায় একটু লবণ কম হলে বা মরিচ বেশি হলেই পুরুষেরা সমালোচনা করতে ছাড়েন না। অনেকেই বাধান তুলকালাম কাণ্ড।
রান্নাকে যে শুধু নারীদের কাজ বলে মনে করা হয় তা নয়, ঘরের অনেক কাজ শুধুই নারীদের। কাজের লোকের অনুপস্থিতির বিকল্প দায়িত্ব নারীদেরই নিতে হয়। খাবারের পর সব তরকারি ফ্রিজে তুলে রাখা, টেবিল পরিষ্কার করা, হাঁড়িপাতিল ধোয়া, ঘরবাড়ি গোছানো—সব মেয়েদের কাজ। এসব কাজ তো এমন কঠিন কিছু নয়। তা-ও পুরুষেরা করবেন না। মেয়েদেরই করতে হবে। আর সন্তান লালন–পালন তো শুধুই মেয়েদের। কোনো কোনো পুরুষ অবশ্য সন্তানের দেখভাল করেন। কিন্তু সেটা কখনোই তাঁদের নিয়মিত কাজের অংশ হয় না। কদাচিৎ তাঁরা এটা করেন। কিছু কাজ শুধু মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখাটা কি মানসিক দীনতার পরিচয় নয়? এখানে নারী-পুরুষের সমতা কোথায়?
যা-ই হোক, ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু নারীদের ছুটি নেই। রান্নাঘরে বাড়ছে তাঁদের ব্যস্ততা। কারও কারও বাড়িতে অতিথি চলে এসেছে। তাঁদের তো ব্যস্ততা আরও বেশি। চলছে মসলা বাটাবাটি। ঈদের রান্না বলে কথা। আসুন না, এই ঈদে পুরুষেরাও রান্নাঘরে একটু সময় দিন। একটু রাঁধুন। বাড়ির লোকজন আর অতিথিরা আপনাদের রান্না করা খাবার খেয়ে দেখুক, ক্ষতি তো কিছু নেই। তা-ই না!

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক